মূসকের সফটওয়্যার কেনায় অস্বচ্ছতা

স্বয়ংক্রিয় মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ব্যবস্থা চালুর জন্য সফটওয়্যার ক্রয়ের দরপত্র নিয়ে অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, কম আর্থিক দর প্রস্তাব দেওয়া তিনটি প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি দর দেওয়া প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
দরপত্রে অংশ নেওয়া ছয়টি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক দরপ্রস্তাবে ক্রম বিবেচনায় ফ্রান্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বুলএসএএস ৪ নম্বরে। অথচ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করেছে। আর বুলএসএএসের চেয়ে ১১ কোটি টাকার কম দর প্রস্তাব করা সত্ত্বেও বিশ্বখ্যাত জার্মান প্রতিষ্ঠান এসএপিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অথচ বিশ্বের রাজস্বসংক্রান্ত তথ্যপ্রযুক্তির বাজারে ৬৩ শতাংশের অংশীদার এসএপি। ভালো প্রতিষ্ঠান, টাকা কম—এমন প্রতিষ্ঠানকেই বাদ দেওয়া হয়েছে।
এমন অবস্থায় বুলএসএএসকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দিয়ে তাদের দর অনুমোদনের জন্য শিগগিরই ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে উঠছে। অনেকটা তাড়াহুড়া করে দরপত্র জমার দুই মাসের মধ্যে তা বাছাই করে চূড়ান্ত করা হয়েছে।
ভিয়েতনামভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এফপিটি ইনফরমেশন সিস্টেম বিশ্বখ্যাত সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান এসএপির পক্ষে এ দরপত্রে অংশ নেয়। আর বাংলাদেশে এসএপির প্রতিনিধি এসএস সলিউশনস লিমিটেড।
এসএস সলিউশনসই গত রোববার এ দরপত্র-প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে চিঠি দিয়েছে। একই অভিযোগ করে বিশ্বব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ট্রেসি এম লেন ও বাংলাদেশে আবাসিক পরিচালক ইয়োহানেস জাটের কাছেও ই-মেইল বার্তা দেওয়া হয়েছে। উভয় চিঠিতে দরপত্র-প্রক্রিয়ায় এ দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতার অভিযোগগুলো একটি আনুষ্ঠানিক তদন্ত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংকের ছয় কোটি ডলার অর্থায়নে রাজস্ব আহরণ কর্মসূচি: মূসক উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এ সফটওয়্যার কেনা হচ্ছে। এরপর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের যন্ত্রপাতি (হার্ডওয়্যার) কেনা হবে। এ সফটওয়্যারের মাধ্যমে মূসক নিবন্ধন থেকে শুরু করে বিবরণী দাখিল, কর পরিশোধ—সবই করা যাবে। আর পুরো মূসকব্যবস্থা একই নেটওয়ার্কের মধ্যে থাকবে। এ সফটওয়্যারের মাধ্যমে মূসক নিবন্ধন থেকে শুরু করে রিটার্ন দাখিল, কর পরিশোধ, সবই করা যাবে। আর পুরো মূসকব্যবস্থা একই নেটওয়ার্কের মধ্যে থাকবে। গত জানুয়ারি মাসে প্রকল্পটি শুরু হয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শেষ হবে।
অন্যদিকে, আয়কর বিভাগের একই ধরনের একটি প্রকল্পে একই রকম সফটওয়্যার কেনার দরপত্র গত ১০ মাসেও দরদাতা চূড়ান্ত করতে পারেনি এনবিআর। অথচ দ্রুততার সঙ্গে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত নিচ্ছে মূসকের সফটওয়্যার কেনার ক্ষেত্রে। সেখানেও দরদাতার তালিকায় এসএপি (এফপিটি) ও বুলএসএএস ছাড়াও রয়েছে ওরাকল ও টাটা কনসালটিং। জানা গেছে, সফটওয়্যার দুটির কার্যধরন একই রকম হওয়ায় যে প্রতিষ্ঠানের মূসক সফটওয়্যার কেনা হবে, আয়কর বিভাগের প্রকল্পের ক্ষেত্রেও সেই প্রতিষ্ঠানেরই সফটওয়্যার কেনা হবে। আয়করের সফটওয়্যার কেনার দর প্রস্তাবে কারিগরিভাবে এসএপি শীর্ষস্থানে রয়েছে। এসএপি সবচেয়ে কম মূল্য প্রস্তাবও করেছে। সে ক্ষেত্রে মূসকের সফটওয়্যার কেনায় অন্য প্রতিষ্ঠানকে আগে কার্যাদেশ দেওয়া হলে এসএপি বাদ পড়ে যাবে।
স্বয়ংক্রিয় মূসক প্রশাসন ও ব্যবস্থা চালু করতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে সফটওয়্যার কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করে এনবিআর। তবে প্রাক্বাছাইয়ের সুযোগ না রেখে সরাসরি কারিগরি ও আর্থিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। কোনো বিদেশি পরামর্শকও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। কিন্তু আয়কর বিভাগের সফটওয়্যার কেনার দরপত্রে বিশ্বখ্যাত কারিগরি পরার্শক প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউস কুপারসকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সাধারণত বিশ্বখ্যাত পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে পরামর্শ দেয়। প্রভাব খাটিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের মত পরিবর্তন করা যায় না। আর মূসকের সফটওয়্যারের দরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এনবিআর ও বিশ্বব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের এত বড় দর প্রস্তাব মূল্যায়ন করার মতো তাদের সক্ষমতা রয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
মূসকের দরপত্র: ফেব্রুয়ারি মাসে দরপত্রে সুগেমা, হেইয়ার, এফটিপি (এসএপি), বুলএসএএস, ইন্ট্রাসফট (ওরাকল) ও ইনভেনিও—এ ছয় প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বুলএসএএস এক কোটি ১৩ লাখ ৯৩ হাজার ডলার দর দেয়। আর বুলএসএসের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম দর দেয় এফটিপি (এসএপি), হেইয়ার ও সুগেমা। এ তিন প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে ৯৯ লাখ ৮৬ হাজার ডলার, ৮৯ লাখ ৪৩ হাজার ও ৮৮ লাখ ১৫ হাজার ডলারের দর প্রস্তাব দেয়। এসএস সলিউশনস অভিযোগপত্রে বলেছে, ২৪ এপ্রিল এনবিআরের পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে, বুলএসএএস ছাড়া দরপত্রে অংশ নেওয়া বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো অযোগ্য। তাই বুলএসএএসকে কার্যাদেশ দেওয়া হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির আরও অভিযোগ, কোনো কারণ না দেখিয়ে তাদের দরপত্রটি বাতিল করা হয়েছে। এমনকি দরপত্র বাছাই করার সময় কোনো তথ্য বা তথ্যের ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়নি। একতরফাভাবেই দরদাতা চূড়ান্ত করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এসএস সলিউশনসের চেয়ারম্যান কাজী সালাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, জার্মানিভিত্তিক এসএপি হলো সফটওয়্যার জগতে সবচেয়ে নামকরা প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে অর্ধশতাধিক নামকরা প্রতিষ্ঠানে এসএপির সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানের সফটওয়্যার সন্নিবেশিত করার জন্য কম দর দেওয়া সত্ত্বেও দরদাতার কাজ না পাওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। কর ব্যবস্থাপনায় এসএপি সফটওয়্যার অত্যন্ত কার্যকর—এটা স্বীকৃত।
তবে প্রকল্পের উপপরিচালক আবদুর রউফ প্রথম আলোকে বলেন, অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে দরপত্র-প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। ক্রয়নীতি অনুযায়ী, ক্রয়সংক্রান্ত কমিটিতে অনুমোদনের পর সব দরদাতাকে বিস্তারিত জানানো হয়। এর আগে কোনো দরদাতাকে কোনো তথ্য দেওয়ার নিয়ম নেই। এতে ক্রয়নীতির কোনো ব্যত্যয় এখানে হয়নি।
উল্লেখ্য, এসএপি সরাসরি এনবিআরের দরপত্রে অংশ নেয়নি। এফপিটি ইনফরমেশন সিস্টেমস হলো এসএপির সহযোগী প্রতিষ্ঠান, যারা এ সফটওয়্যার সন্নিবেশিত করবে। এসএস সলিউশনস দাবি করছে, বিশ্বের রাজস্বসংক্রান্ত তথ্যপ্রযুক্তির বাজারে ৬৩ শতাংশের অংশীদার এসএপি। এ প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক ব্যবসার পরিমাণ প্রায় ১৭ বিলিয়ন ইউরো। আর বুলের বার্ষিক ব্যবসার পরিমাণ ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ইউরো।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গার্টনারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত পণ্যের মানের দিক থেকে এসএপির ‘অতি উত্তম’, আর বুলএসএসের পণ্য ‘ভালো’।
আয়কর বিভাগের একই ধরনের উপরোল্লিখিত একটি প্রকল্পে একই রকম সফটওয়্যার কেনার জন্য গত বছরের জুলাই মাসে দরপত্র আহ্বান করা হয়। সেখানে আর্থিক ও কারিগরি, এ দুই স্তরে দরপত্র আহ্বান করা হলেও মূসকের প্রকল্পের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। আয়কর বিভাগের সেই দরপত্রেও কারিগরি স্তরে উত্তীর্ণ হয় এসএপি (এফপিটি), বুলএসএএস, ওরাকল ও টাটা কনসালটিং। এরপর গত ফেব্রুয়ারি মাসে এসব প্রতিষ্ঠান তাদের আর্থিক দর প্রস্তাব দেয়। কিন্তু এখনো দরদাতা চূড়ান্ত করা হয়নি। অথচ মূসকের ক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারি মাসে দরপত্র আহ্বান করে দুই মাসের মধ্যে তাড়াহুড়া করে দরদাতা চূড়ান্ত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, নতুন আয়কর ও মূসক আইন বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে আয়কর ও মূসক বিভাগ স্বয়ংক্রিয় অনলাইন ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে।