বগুড়ায় পোড়াদহ মেলায় ৯০ কেজির বাগাড়!

বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলায় ৯০ কেজি ওজনের একটি বাগাড়ের দাম হাঁকা হয়েছে সোয়া লাখ টাকা। ছবি: ফোকাস বাংলা
বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলায় ৯০ কেজি ওজনের একটি বাগাড়ের দাম হাঁকা হয়েছে সোয়া লাখ টাকা। ছবি: ফোকাস বাংলা

সাতসকালেই ইছামতী নদীর তীরে মানুষের ঢল। নদীর তীরে বসেছে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা। দূরদূরান্ত থেকে দল বেঁধে লোকজন মেলায় ছুটে আসছেন। মেলা উপলক্ষে আশপাশের ৩০ গ্রামে রীতিমতো উৎসবের আমেজ। গৃহস্থ ঘরে নাইওর এসেছে নববধু আর মেয়েজামাই। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় অন্যবারের মতো এবারও মেলায় উঠেছে নদীতে ধরা হরেক প্রজাতির বিশাল বিশাল মাছ। ৯০ কেজি ওজনের একটি বাগাড়ের দাম হাঁকা হয়েছে সোয়া লাখ টাকা। কয়েকজন ক্রেতা এক লাখ টাকায় দর কষাকষি করেছেন।
আজ বুধবার সকালে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলার দৃশ্য ছিল এমনটাই। প্রায় চারশ বছর ধরে মহিষাবান ইউনিয়নের গোলাবাড়ি বন্দরে ইছামতী নদীর তীরে প্রতি মাঘ মাসের শেষ বুধবারে বসে এই মেলা। নদীতে ধরা বিশাল আকৃতির মাছ ছাড়াও এবারের মেলায় অন্যতম আকর্ষণ ছিল ১৫ কেজি ওজনের রসে ভাষা ‘বালিশ মিষ্টি’।
গাবতলীর গোলাবাড়ি গ্রামের প্রবীণ আবদুর রহমানসহ সাত থেকে আটজন বলেন, ‘কবে থেকে মেলা শুরু হয়েছিল তা সঠিক করে বলা মুশকিল। তবে লোকজনের ধারণা, প্রায় চারশবছর আগে সন্ন্যাসী পূজা উপলক্ষে প্রথম বসে এই মেলা। ওই সময় ইছামতী নদীসংলগ্ন পোড়াদহ নামক স্থানে প্রতিবছরের মাঘ মাসের শেষ বুধবারে একটি বটবৃক্ষতলে আয়োজন করা হতো সন্ন্যাসী মেলা। মেলায় বিকিকিনি হতো ইছামতী,বাঙালি আর যমুনা নদীর বড়বড় মাছ। কালের বিবর্তনে প্রায় একশ একর জমির ওপর বসা একদিনের এই মেলা হয়ে উঠেছে এখন এই অঞ্চলের মানুষের মিলনমেলা।’

গোলাবাড়ি গ্রামের আবদুল জোব্বার বলেন, ‘মেলা উপলক্ষে নবধূরা নাইওর আসেন শ্বশুরবাড়িতে। বাবার বাড়িতে নাওয়র আসেন মেয়ে-জামাই। একদিন আগে থেকেই সাজ সাজ রব পড়ে যায় চারদিকে। ৩০ গ্রামজুড়ে উৎসব আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। মেলা উপলক্ষে আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত খাওয়ানো এখন এই এলাকার মানুষের সামাজিক রীতিতে পরিণত হয়েছে। ’
বুধবার সকালে মেলার আশপাশের গ্রামগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেওয়াজ অনুযায়ী এবারও মেলা উপলক্ষে ঘরে ঘরে মেয়ে-জামাই, আত্মীয়-স্বজন নিমন্ত্রণে এসেছেন।
মেলায় গিয়ে দেখা গেছে, এবারও উঠেছে নদীর বাগাড়, পাঙাস, চিতল, কাতল, সিলভার কার্পসহ বড়বড় মাছ।
মাছ ব্যবসায়ী মাসুদ রানা মেলায় বিক্রি করতে এনেছেন ৯০ কেজি ওজন একটি বাগাড়। তিনি মাছটির দাম হাঁকছেন এক লাখ ২৬ হাজার টাকা। ক্রেতা আসলাম আলী দিতে চান এক লাখ। মাসুদ রানা বলেন, কয়েকদিন আগে যমুনায় জেলেদের জালে মাছটি ধরা পড়েছে। ক্রেতা আসলাম আলী বলেন, ‘দশজন মিলে এ মাছ কিনতে চাচ্ছি। দরদামে মিলে গেলে কেটে ভাগাভাগি করে নেব।’
ব্যবসায়ী সাহেব আলী বিক্রি করতে এনেছেন ৭০ কেজি ওজনের আরেকটি বাগাড়। তিনি দাম হাঁকছেন এক লাখ টাকা। কয়েকজন ক্রেতা ভাগাভাগি করে সেটি ৭০ হাজার টাকায় কিনতে চাইলেন। কিন্তু তাতেও রাজি হননি সাহেব আলী।
নাটোরের সিংড়া থেকে ২৫ কেজি ওজনের কয়েকটি কাতলা মাছ বিক্রি করতে এসেছেন ব্যবসায়ী আসলাম হোসেন। তিনি বলেন, ‘হরতাল-অবরোধে এবার মেলা ঠিকমতো জমেনি। পথে পথে অনেক কষ্ট করে হরতালে মেলায় এসেছি। বিক্রি না হলে লোকসান দিতে হবে।’ বাসেদ আলী নামের অপর এক ব্যবসায়ী ৪০ কেজি ওজনের পাঙাশ বিক্রি করতে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘অন্যবার এ মেলায় বড় মাছের কদর ছিল বেশি, এবার ছোট মাছ বেশি বিক্রি হচ্ছে।’
মেলায় মাছ কিনতে আসা সোনাতলার কলেজ স্টেশনের রহিমুদ্দি শেখ বলেন, ‘বাপ দাদার আমল থ্যাকে এ মেলায় বড় মাছ কিনবার আসিচ্চি। এবার কিনবার আ্যাসে মাথা হাত পরিচ্চে। দামত ভাউ দিবার পারিচ্চি না।’
হরতালে চার বন্ধু মিলে সাইকেলে চড়ে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা থেকে মেলা দেখতে এসেছেন কলেজ ছাত্র রঞ্জু মিয়া। তিনি বলেন, ‘মেলার অনেক নামডাক শুনেছি। এবার চার বন্ধু মিলে দেখতে এসেছি। বড় মাছ দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে।’

১৫ কেজি ওজনের ‘বালিশ মিষ্টি’
মেলায় এবারও উঠেছে ১০ থেকে ১৫ কেজি ওজনের বড় বড় মিষ্টি। ঘন রসে ভাসা এ মিষ্টির স্থানীয় নাম ‘বালিশ মিষ্টি’। মিষ্টি ব্যবসায়ী বাদশা মিয়ার ভাষ্য, ‘এই মেলার আকর্ষণ বড় মিষ্টি। এই মিষ্টি বিক্রি করা হচ্ছে প্রতিকেজি দুশ টাকা। কিন্তু এবার মেলায় লোক সমাগম কম হওয়ায় বড় মিষ্টির ক্রেতাও কম।’
সকাল থেকেই শিশু কিশোরদের ভিড়ে সরগরম হয়ে উঠেছিল এই মেলা। শিশুরা নাগরদোলায় চড়ে, হরেক খেলনা আর রঙিন বেলুন কিনে আনন্দ ফুর্তি করে। মেলায় উঠেছিল আসবাব,গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় নানা সামগ্রী,মসলাসহ হরেক পণ্যের পসরা।