মৃত্যুর আগেও তারা দেখে গেলেন তিনি

এ আর খান
এ আর খান

গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে তাঁর আকর্ষণ ছিল বরাবরই। সেদিনও তাই মেঘমুক্ত আকাশের তারা দেখার সুযোগটি হাতছাড়া করেননি। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে লন্ডনের টেমস নদীর তীরে তারা দেখেছেন। কিন্তু ফেরার পথে রেলস্টেশনে পড়ে গিয়ে সংজ্ঞা হারালেন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ হারাল জ্যেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী আনোয়ারুর রহমান খানকে, যিনি এ আর খান নামেই পরিচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এ আর খান বাংলাদেশের বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। গতকাল সোমবার বাংলাদেশ সময় ভোর চারটা ৫০ মিনিটে (স্থানীয় সময় রোববার রাত ১১টা ৫০) মিনিটে লন্ডনের সেন্ট মেরিস হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয় (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। তিনি দুই মেয়ে ইরফাত খান ও নিশাত শরীফকে রেখে গেছেন।
লন্ডনপ্রবাসী নিশাত শরীফ প্রথম আলোকে জানান, গত বৃহস্পতিবার এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে আকাশে তারা দেখতে দেখতে সাউথ ব্যাংকের পাতাল রেলস্টেশনে গিয়ে রেলে চড়েন বাবা-মেয়ে। এমব্যাঙ্কমেন্ট স্টেশনে এসে তাঁরা অন্য একটি ট্রেনে উঠতে যাচ্ছিলেন। তখন রাত প্রায় পৌনে ১১টা। এ সময় কিছুটা পেছনে থাকা নিশাত দেখেন যে তাঁর বাবা ট্রেনে উঠতে গিয়ে পেছনের দিকে পড়ে গেলেন। অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁকে প্যাডিংটনের সেন্ট মেরিস হাসপাতালে নেওয়া হয়। গতকাল সেখানে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
বাংলাদেশের বরেণ্য এই জ্যোতির্বিজ্ঞানীর জন্ম ১৯৩২ সালে তৎকালীন ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে। ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে এমএসসি পাস করার পর তিনি একই বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে ১৯৬০ সালে কলম্বো প্ল্যান ফেলো হিসেবে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরি ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে গবেষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬২ সালে লন্ডনের ইমপেরিয়েল কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষকতা করার সময় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকায় ফিরে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন, ১৯৬৭ সালে।
স্বাধীনতার পর এ আর খান ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে (অধুনা তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ) যোগ দেন। ১৯৯২ সালে এই বিভাগ থেকে তিনি অবসরে যান।
দেশে বিজ্ঞানচর্চা, বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চার প্রসারে এ আর খান আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। ১৯৭৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঈসা খাঁ সড়কে তাঁর বাসভবনের গ্যারেজে প্রতিষ্ঠা করেন অনুসন্ধিৎসু চক্র বিজ্ঞান সংগঠনের। ১৯৮৪ সালে তিনি গড়ে তোলেন বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশে হ্যালির ধূমকেতু পর্যবেক্ষণের জন্য গঠিত জাতীয় কমিটির তিনি ছিলেন আহ্বায়ক।
ইউনেসকো ২০০৯ সালকে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান বছর হিসেবে পালন করে। প্যারিসে সেই উদ্যাপনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
অবসর গ্রহণের পর থেকে ২২ বছর ধরে দেশে বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চার প্রসারে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন বিজ্ঞান সংস্কৃতি পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য। চলতি বছর থেকে শুরু হওয়া হাইস্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য সিটি ব্যাংক ও প্রথম আলো আয়োজিত বিজ্ঞান জয়োৎসবের উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি।
নিশাত জানান, আগামী শুক্রবার সাউথ হলের সেন্ট্রাল জামেয়া মসজিদে জুমার নামাজে পর এ আর খানের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। লন্ডনের পাওয়ার মিল লেন কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী তাঁর বড় মেয়ে ইরফাত খানও বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন।
ঢাকা শহরে সাইকেলে বা হেঁটে ঘুরে বেড়াতেন এই ৮৪ বছর বয়সের চিরতরুণ। তরুণদের বলতেন, সাইকেল চালালে স্বাস্থ্য ভালো থাকে, পরিবেশও দূষণমুক্ত থাকে। শিশুদের তারা চেনানোর জন্য ছুটে যেতেন দেশের আনাচে-কানাচে।
শোক প্রকাশ: এ আর খানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক এফ আর সরকার, অনুসন্ধিৎসু চক্র বিজ্ঞান সংগঠনের সভাপতি আমানুল ইসলাম প্রমুখ।