বিএনপির নীরবতা বিস্ময়কর নয়

বিএনপির নেতা আবদুল আলীমের আমৃত্যু কারাদণ্ড বাংলাদেশের আইনি ইতিহাসে একটি নতুন মাত্রা বা আলোচনার সূচনা ঘটাতে পারে। এর আগে বিজ্ঞ বিচারকদের কাছ থেকেই শুনেছিলাম, বাংলাদেশ একটি আইনগত ব্যাখ্যা ভুলভাবে প্রয়োগ করছে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে অনধিক ৩০ বছর নয়। ভারতীয় আইনবিদদেরও নাকি তেমনই অভিমত। এর অর্থ দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি তাঁর জীবদ্দশায় আর বাইরে বেরোতে পারবেন না। তাঁকে কারাগারেই মরতে হবে। বেঁচে থাকতে তাঁর মুক্তি নেই।

আবদুল আলীম বয়সে অত্যন্ত প্রবীণ। তাই তাঁর ক্ষেত্রে ১০ বা ২০ বছরের সাজা প্রদানও যথেষ্ট ছিল। কিন্তু প্রশ্নটি নিশ্চয় বয়সগত নয়। অবশ্য এবারে পঙ্গুত্বের প্রশ্নটি এসেছে। আদালত কাদের মোল্লার যাবজ্জীবনকে ‘আমৃত্যু’ ভাষায় বলেননি। আদালত এবারে যাবজ্জীবন শব্দটি বলেননি। বলেছেন তিনি তাঁর জীবনের অবশিষ্ট সময় কারাগারে থাকবেন। এর অর্থ তিনি যাবজ্জীবনই পেয়েছেন, তবে সেটা আমৃত্যু কারাগারে। মনে হচ্ছে এবারে রাষ্ট্রপক্ষ আদালতের সাবধানবাণী মনে রেখেছে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় দেখে মত দেবেন। ভালো এটা। আসামিপক্ষের আইনজীবীর প্রতিক্রিয়াও জানা যায়নি।

রায়ের আগে ও পরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উত্তেজনার অনুপস্থিতি প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে ব্যক্তি ও ব্যক্তির অবস্থানই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার পরে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবদুল আলিম ১৯৭৫ সালে জয়পুরহাট পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান হন। ১৯৭৯ সালে প্রথমে বস্ত্র, পরে রেল ও যোগাযোগমন্ত্রী, ১৯৮৪ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে বিএনপি থেকে জয়পুরহাট-১ আসনে সাংসদ নির্বাচিত হন। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি সংস্কারপন্থী হিসেবে বিএনপির সাবেক মহাসচিব মান্নান ভূঁইয়ার অনুসারী হলে পরিত্যক্ত হন।

আমাদের জয়পুরহাট প্রতিনিধি আসাদুল ইসলাম জানালেন, ‘একজন সংস্কারপন্থী হিসেবে জয়পুরহাটের বিএনপির দৃশ্যপটে তিনি এক-এগারো থেকেই অনুপস্থিত।’ অবশ্য জয়পুরহাটে যদি সক্রিয় থাকতেনও তিনি আর সাকা চৌধুরীর মতো ‘মর্যাদা’ আশা করতে পারেন না। কারণ চলমান রাজনীতিতে কাজে না লাগলে কোনো নেতাই কাজের নন। সে কারণেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক এবং মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দরকারি নন। তাঁদের ছবি পোস্টারে কালে ভদ্রে দেখা যায়। কারণ তাঁরা ভোট টানেন না। আলীমের প্রতি বিএনপির নিরাসক্ত মনোভাব অবশ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতি দলটির স্ববিরোধিতার পরিচায়ক।

দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে আবদুল আলীম কেবল জয়পুরহাটেই রাজনীতি করেছেন। জাতীয় রাজনীতিতে তেমন অবদান রাখেননি।  সাকার ক্যারিশমাও দেখাতে পারেননি। সে কারণে তাঁর দণ্ডের জন্য বিএনপি সারা দেশে বিক্ষোভ করবে না। খন্দকার মাহবুব হোসেনরা উতলা হবেন না। ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে আলীম ‘সংস্কারপন্থী’ হিসেবে তত্কালীন সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন। বিএনপির দুর্দিনে তিনি দলীয়প্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে কটাক্ষ করে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বক্তব্যও দেন। ২০০৭ সালের ৪ আগস্ট জয়পুরহাট জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত বর্ধিত সভায় আবদুল আলীমসহ তাঁর বেশ কিছু অনুসারীকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির টিকিট না পাওয়ায় তিনি নির্বাচন থেকে বিরত থাকেন।

এ রকম পটভূমির একজন দণ্ডিতের জন্য বিএনপি খামাখা কথা খরচ করবে কেন? এই হলো বিএনপির আইনের শাসনের মাপকাঠি। জামায়াতের পাঁচজনের ফাঁসি হলো। বিএনপি চুপ থাকল। তার কাছে ওই ফাঁসি তেমন আপত্তির নয়। আবার সাকার ফাঁসিতে সরব। আলীমের যাবজ্জীবনে নীরব। এভাবে তারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধই কেবল নয়, পুরো অপরাধ ও বিচারব্যবস্থাকে দেখে থাকে।

এসব সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়ার দ্রুততা ও এর যৌক্তিক পরিণতি আমরা দেখতে উদগ্রীব। আলীমের দণ্ডাজ্ঞা আরেক ধাপ অগ্রগতি। জয়পুরহাটবাসী ও নাগরিকদের আত্মজিজ্ঞাসারও একটি দিন আজ। বিপুল ভোট ও বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ মানেই কারও নিষ্কলুষ চরিত্রের সনদ নয়।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক