মামলা হয়, বিচার হয় না

ভাগ্যান্বেষণে সাগরপথে বিদেশে যাচ্ছিলেন তাঁরা। তবে সফল হয়নি সেই অবৈধ চেষ্টা। মিয়ানমার উপকূলে সম্প্রতি উদ্ধার হন এই বাংলাদেশিরা। সঙ্গে যা কিছু ছিল, তা হাতে নিয়ে গতকাল দেশে ফেরেন তাঁরা। উখিয়ার ঘুমধুম সীমান্তের বাংলাদেশ-মিয়ানমার মৈত্রী সেতু থেকে তোলা ছবি l রয়টার্স
ভাগ্যান্বেষণে সাগরপথে বিদেশে যাচ্ছিলেন তাঁরা। তবে সফল হয়নি সেই অবৈধ চেষ্টা। মিয়ানমার উপকূলে সম্প্রতি উদ্ধার হন এই বাংলাদেশিরা। সঙ্গে যা কিছু ছিল, তা হাতে নিয়ে গতকাল দেশে ফেরেন তাঁরা। উখিয়ার ঘুমধুম সীমান্তের বাংলাদেশ-মিয়ানমার মৈত্রী সেতু থেকে তোলা ছবি l রয়টার্স

দেশে মানব পাচার আইনে গত সাড়ে তিন বছরে দেড় হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। আসামির সংখ্যা ছয় হাজারের বেশি। সমঝোতার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র আটটি মামলা। তবে কারও শাস্তি হয়নি।
মানব পাচার আইন অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে অভিযোগ গঠন এবং ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার কথা। কিন্তু একটি মামলার ক্ষেত্রেও সেটি হয়নি। এই আইনে অপরাধ অজামিনযোগ্য হলেও আসামিরা জামিন পেয়ে আবার পাচারে যুক্ত হচ্ছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পাচার আইনে দায়ের করা দেড় হাজারের বেশি মামলায় এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এক হাজার ৮৫৩ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হলেও প্রায় সবাই জামিন পেয়ে গেছে।
পুলিশ সদর দপ্তর ও কক্সবাজার জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে মানব পাচার আইন হওয়ার পর এ বছরের মে মাস পর্যন্ত শুধু কক্সবাজারেই ৩২৪টি মামলা হয়েছে। কিন্তু একটি মামলারও বিচারকাজ শেষ হয়নি। আর সারা দেশে মানব পাচারের ঘটনায় এ বছরের মে পর্যন্ত মোট মামলার সংখ্যা ১ হাজার ৫৯০টি। বিচার হয়েছে এমন ঘটনা নেই বললেই চলে।
বঙ্গোপসাগর দিয়ে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মানব পাচার রোধে প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা তৈরির জন্য গত বছর পুলিশের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি করা হয়েছিল। মানব পাচারের কারণ ও এ ধরনের ঘটনা বন্ধে ওই কমিটি ১৭ ডিসেম্বর পুলিশ সদর দপ্তরে প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদনেও বিচারের বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করা হয়।
এতে বলা হয়, মানব পাচার-সংক্রান্ত মামলাগুলো গতানুগতিকভাবেই তদন্ত করা হয়ে থাকে। পাচারের শিকার মানুষের অসহায়ত্বের কারণে শেষ পর্যন্ত আদালতে উপস্থিত না হওয়ায় আসামিরাও খালাস পেয়ে যায়। আবার তদন্ত করে অভিযোগপত্র দিলেও আসামিদের গ্রেপ্তারে উদ্যোগ নেওয়া হয় না। সরকারের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে নজরদারি নেই।
আইন মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর সূত্রে জানা গেছে, মানব পাচার আইনের ২১(২) ধারা অনুযায়ী, অপরাধসমূহ বিচারের জন্য দায়রা জজ কিংবা অতিরিক্ত দায়রা জজ পদমর্যাদার বিচারকের সমন্বয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠন করার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো জেলায় ট্রাইব্যুনাল হয়নি। ফলে এখনো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এই মামলার বিচার চলছে। এ ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে দীর্ঘসূত্রতা। কারণ, এই আদালতে ১০ বছরের পুরোনো ৭২টি এবং পাঁচ বছরের পুরোনো ৩২৭টি মামলা আছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অবশ্য কয়েক দিন আগে মানব পাচার অপরাধের বিচারে সাত বিভাগে ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা জানিয়েছেন। তবে কবে নাগাদ সেটি হবে, আর কবেই বা বিচার শুরু হবে, সে বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়।
জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মানব পাচার মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এই অপরাধগুলোর বিচার না হলে অপরাধীরা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। প্রধান বিচারপতির কাছে তিনি অনুরোধ করেছেন, ট্রাইব্যুনাল করে মানব পাচারের মামলাগুলোর বিচার যেন দ্রুত শেষ করা হয়।
আগে পাচারের ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হতো। কিন্তু এ-সংক্রান্ত অপরাধ বিচারের জন্য সরকার ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন প্রণয়ন করে। পুলিশ সদর দপ্তরের মানব পাচার পর্যবেক্ষণ সেলের তথ্য অনুযায়ী, ওই আইন হওয়ার পর ২০১২ সালে ২৪৩টি, ২০১৩ সালে ৩৭৭, ২০১৪ সালে ৬৮২ এবং ২০১৫ সালের মে পর্যন্ত ২৮৮টি মামলা হয়।
মানব পাচার আইন হওয়ার পরপরই একটি মামলা করেছিলেন নওগাঁর বাবু। তাঁকে জাল কাগজপত্র দিয়ে মিসরে পাঠানো হয়েছিল। দেশে ফিরে ২০১২ সালের ৭ মে নওগাঁর আদালতে তিনি মামলা করেন। মামলাটির কী অবস্থা জানতে চাইলে বাবু বলেন, আসামিরা এখন জামিনে। মামলাটিও আদালতে আছে। কবে শেষ হবে, আদৌ বিচার হবে কি না, তাঁর জানা নেই। একইভাবে আক্ষেপের কথা বলেছেন শফিকুল ইসলাম, বিল্লাল মিয়া, আমিনুল ইসলামসহ আরও অনেকে। তাঁরা কেউই বিচার পাননি।
অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারি সংগঠনের কর্মী আল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশে পাঠানোর নামে প্রতারণা ও পাচারের ঘটনার ২৩টি মামলায় আইনগত সহায়তা দিচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু একটি মামলারও বিচার হয়নি।
জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি সূত্রে জানা গেছে, মানব পাচার আইন হওয়ার পর তারা ৩০টির বেশি মামলায় আইনগত সহায়তা দিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনোটিরই রায় হয়নি।
সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী প্রথম আলোকে বলেন, ২০১২ সালে যে আইনটি করা হয়েছিল, সেটি একটি পূর্ণাঙ্গ আইন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ আইনের অধীনে এখনো ট্রাইব্যুনাল হয়নি। তাই এখনো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতকে মামলাগুলো দেখতে হয়। কিন্তু এই আদালত পুরোনো মামলা নিয়েই জর্জরিত।
জাতীয় মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটির এই সদস্য বলেন, কক্সবাজারের পাচারের ঘটনায় এখন তো বিভিন্ন বাহিনীর লোকজনের জড়িত থাকার কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এসব মামলার তদন্তও ঠিকমতো হয় না। আসামিরা জামিন পেয়ে যায়। আর সঠিক বিচার না হলে এ ধরনের অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়।
কক্সবাজার পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আইন হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে কক্সবাজারে। ২০১২ সালে ২৭টি, ২০১৩ সালে ৮১, ২০১৪ সালে ১৪০টি এবং ২০১৫ সালের মে পর্যন্ত ৭৬টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এক হাজার ৬২৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। ৫২৫ জন গ্রেপ্তার হলেও প্রায় সবাই এখন জামিনে।
কক্সবাজার পুলিশের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মানব পাচার আইনের ১৬ ধারা অনুযায়ী, এসব মামলা অজামিনযোগ্য-জামিনযোগ্য এবং আপসযোগ্য নয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আসামিরা জামিন পেয়ে যাচ্ছেন এবং আবারও একই অপরাধে যুক্ত হচ্ছেন।
কক্সবাজার আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মমতাজ আহমেদও জানান, এখন পর্যন্ত কোনো মামলার রায় হয়নি। তবে কয়েকটি মামলার বিচার চলছে।
মানব পাচার আইনে বলা হয়েছে, পাচার-সংক্রান্ত অপরাধগুলোর বিচার শুধু ট্রাইব্যুনাল করবে। ২ এর ১ ধারায় বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনাল না হওয়া পর্যন্ত সরকার প্রতিটি জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালকে মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের মানব পাচার পর্যবেক্ষণ সেলের তথ্য অনুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে এখন পর্যন্ত মোট ৬৮৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে আটজনের মৃত্যুদণ্ড এবং ২৮০ জনকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত সাড়ে তিন বছরে নিষ্পত্তি হয়েছে ১৫৭টি মামলা। এর মধ্যে ২৪টি মামলায় ৩০ জনের যাবজ্জীবনসহ মোট ৪৩ জন সাজা পেয়েছে। আর ১৩৩টি মামলায় ৪১৬ জন খালাস পেয়ে গেছে। তবে মানব পাচার আইন হওয়ার পর আটটি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে সমঝোতার ভিত্তিতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মানব পাচার পর্যবেক্ষণ সেলের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গত তিন বছরে যেসব মামলার রায় হয়েছে, সেগুলোর সবই নারী ও শিশু নির্যাতনের।
মানব পাচার রোধে পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কমিটি গত বছর যে আটটি সুপারিশ করেছিল, তাতে বলা হয়েছে, মানব পাচারের মামলাগুলো সঠিক ও নিবিড় তদন্তের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করতে একটি উচ্চপর্যায়ের পর্যবেক্ষণ সেল করা হোক। এতে স্বরাষ্ট্র, আইন ও অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রতিনিধি থাকা আবশ্যক। এ ছাড়া এ মামলার বাদী ও সাক্ষীরা দুর্বল হওয়ার কারণে তাঁদের হাজিরার বিষয়েও একটি সেল গঠন করা যেতে পারে। আর মানব পাচারের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে দ্রুত ট্রাইব্যুনাল করা যেতে পারে। তবে এসব সুপারিশের একটিও বাস্তবায়িত হয়নি।
ওই কমিটির সদস্য কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমদ গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন সাধারণ মানুষও বোঝে, অপরাধের বিচার হলে অপরাধ কমে। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত পাচারের ঘটনায় একটি মামলারও রায় পাইনি। আমাদের সুপারিশগুলোও বাস্তবায়িত হয়নি। তবে সরকার পাচারের মামলাগুলো বিচারে ট্রাইব্যুনাল করবে বলে আমরা জানতে পেরেছি। আশা করছি, এবার অন্তত বিচার হবে।’