মন্ত্রিসভার আকার বাড়লেও চমক নেই

বঙ্গভবনে গতকাল মন্ত্রিপরিষদের নতুন সদস্যদের শপথের পর তাঁদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ l ছবি: বাসস
বঙ্গভবনে গতকাল মন্ত্রিপরিষদের নতুন সদস্যদের শপথের পর তাঁদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ l ছবি: বাসস

মন্ত্রিসভার আকার বাড়লেও গুণগত পরিবর্তন হয়নি। নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে থাকা বর্তমান মন্ত্রিসভার এই ছোট রদবদলে কোনো চমক নেই বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় কাল মঙ্গলবার নতুন একজন মন্ত্রী ও দুজন প্রতিমন্ত্রী যোগ হয়েছেন। আর পুরোনো দুজন প্রতিমন্ত্রী পদোন্নতি পেয়ে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এই পাঁচজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে শপথ পড়ান। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
শপথ নেওয়া পাঁচজনের মধ্যে আসাদুজ্জামান খান কামাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ইয়াফেস ওসমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। তাঁরা পদোন্নতি পেয়ে আগের মন্ত্রণালয়েরই পূর্ণ মন্ত্রী হলেন। আর শিল্পপতি নুরুল ইসলাম বিএসসি টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রী হয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছেন সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ তারানা হালিম এবং সাংসদ নূরুজ্জামান আহমেদ। তারানা ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং নূরুজ্জামান খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। এখন মন্ত্রীর সংখ্যা দাঁড়াল ৩২ এবং প্রতিমন্ত্রী ১৭।
কথিত নিষ্ক্রিয়তার কারণে সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফকে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছুটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় এবং এই পটভূমিতে মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের বিষয়ে কিছুটা কৌতূহল তৈরি হয়। কিন্তু বিভিন্ন অভিযোগ ও বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা কয়েকজন মন্ত্রী স্বপদে বহাল থাকায় মন্ত্রিসভার কোনো গুণগত পরিবর্তন ঘটেনি। এ ছাড়া দৃশ্যমান কোনো সাফল্য না থাকলেও দুজন প্রতিমন্ত্রী পদোন্নতি পেলেন।
আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা ও সাংসদ মনে করেন, মন্ত্রিসভার এই রদবদলে সরকারের কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এই রদবদল অনেকটা প্রসাধনমূলক। এতে সরকার সুদৃঢ় বা মজবুত হবে না।
এই রদবদল সম্পর্কে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই পরিবর্তনে ইতিবাচক কিছু দেখছি না। মন্ত্রিসভা থেকে বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে নতুন মুখ নেওয়া হলে সরকার গতিশীল হতো। সবার জন্য কল্যাণ হতো।’ তিনি বলেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে বিতর্কিত দুই মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি উঠল। অথচ সৈয়দ আশরাফকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করার মধ্য দিয়ে ভালো লোকদের কোণঠাসা করা হলো।
মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকলেও বাদ পড়েননি কেউ। বিশেষ করে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ আহরণের দায়ে নিম্ন আদালতের দেওয়া ১৩ বছরের সাজা হাইকোর্ট বাতিল করলেও আপিল বিভাগ সেই রায় বাতিল করে দেওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনের অভিযোগ ওঠে। একইভাবে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের গম কেলেঙ্কারি নিয়ে সারা দেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ ছাড়া মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে অদক্ষতার অভিযোগও আছে। কিন্তু এসব বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেই।
ইয়াফেস ওসমান সাড়ে ছয় বছর ধরে টেকনোক্র্যাট কোটায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি একজন স্থপতি ও ছড়াকার। মন্ত্রিসভার বৈঠকে মাঝেমধ্যে তিনি স্বরচিত ছড়া আবৃত্তি করেন। এবার তিনি একই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী হলেন। ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার টানা দ্বিতীয়বার সরকার গঠনের পর আসাদুজ্জামান খান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এবার তিনি এই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ দায়িত্ব পেলেন।
নুরুল ইসলাম বিএসসি চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তিনি একজন শিল্পপতি ও সানোয়ারা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে তিনি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিরোধী হিসেবে পরিচিত। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বন্দর নগরের একটি আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন। দশম সংসদ নির্বাচনে এই আসনটি জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিনকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
তারানা হালিম নবম ও বর্তমান সংসদে সংরক্ষিত আসনে নারী সাংসদ। তিনি একসময় নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেন। লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নূরুজ্জামান আহমেদ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রথমবারের মতো সাংসদ হয়েছেন। তিনি একসময় উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। চেয়ারম্যান থাকাকালে থানায় কর্তব্যরত পুলিশের এক উপপরিদর্শককে মারধরের অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে।
এই রদবদল সম্পর্কে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা গতানুগতিক মনে হয়েছে আমার কাছে। নতুন কিছু মনে হয়নি। সবকিছু নির্ভর করছে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হলো তাঁদের কর্মদক্ষতার ওপর।’
শপথ অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। তবে সদ্য দপ্তর হারানো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যাননি।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসে ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নেয়। সরকার গঠনের পর এই মন্ত্রিসভায় এটাই কার্যত প্রথম রদবদল। গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি এ এইচ মাহমুদ আলীকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং নজরুল ইসলামকে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর গত দেড় বছরে আর কোনো পরিবর্তন হয়নি।
এর আগে পবিত্র হজ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের পর আবদুল লতিফ সিদ্দিকী গত বছরের ১২ অক্টোবর মন্ত্রিসভা ও দল থেকে বাদ পড়েন। ৯ জুলাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় মন্ত্রিসভারই আরেক সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে।