কার সম্পত্তি নিলামে তুলছে অগ্রণী ব্যাংক!

.
.
ভবন নির্মাণের জন্য বিতর্কিত মুন গ্রুপকে ১১৫ কোটি ঋণ দেওয়া হয় অথচ জমি আরেকজনের, ব্যাংকের নিলাম ডাকা নিয়েই প্রশ্ন

জমির মালিকানা নিশ্চিত না হয়ে ঋণ দিয়ে এবার আরেক জটিলতায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক। বৈধ কাগজপত্র না থাকা সত্ত্বেও বিতর্কিত মুন গ্রুপের একটি প্রকল্পে অগ্রণী ব্যাংক ১১৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল তিন বছর আগে। সেই ঋণ নিয়ে রাজধানীর কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন ৫২ শতাংশ জমির ওপর ২০তলা ভবন তৈরি করে গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মুন বাংলাদেশ লিমিটেড।

কিন্তু ভবনটি ছিল অবৈধভাবে দখল করা জমির ওপর তৈরি। মুন গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলাও রয়েছে এ ব্যাপারে। মামলার আরজিতে বলা আছে, মিরপুর পাইকপাড়া মৌজার সিএস ৫৫৫ দাগের ৫২ শতাংশসহ মোট ১২০ শতাংশ জমি জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দখল করেছেন মিজানুর রহমান। জমির প্রকৃত মালিক শেখ মো. জয়নাল আবেদীন ও তাঁর পুত্র এবং জমির আমমোক্তার শেখ মো. আবদুল গণি।

জয়নাল আবেদীনের বিরুদ্ধেও পাল্টা মামলা করেছিলেন মুন গ্রুপের মিজানুর রহমান। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা জজের আদালতে মিজানুর রহমানের করা মামলাটি খারিজ হয়ে গেছে। আর মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে করা মামলা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি, অর্থাৎ আদালতে বিচারাধীন।

জমির মালিকানা নিয়ে বিচারাধীন মামলার আরজি ও রায়ের কপি এবং জমির প্রকৃত দলিল আবদুল গণি অগ্রণী ব্যাংকে দাখিল করেছেন কয়েক বছর আগেই। কিন্তু অগ্রণী ব্যাংক ভবনসহ সেই জমি এখন ১৩২ কোটি টাকায় বিক্রির জন্য নিলাম ডেকেছে। ২০ আগস্ট নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।

এ অবস্থায় নিলাম ডাকা যায় কি না, জানতে চাইলে ব্যাংক কোম্পানি আইন নিয়ে কাজ করা আইনজীবী তানজীব-উল-আলম প্রথম আলোকে বলেন, মিজানুর রহমানকে যে জমির ওপর ভবন তৈরির জন্য ঋণ দেওয়া হলো, তিনি যদি ওই জমির মালিক না হয়ে থাকেন, তাহলে ওই জমির ওপর অগ্রণী ব্যাংকের বন্ধকি-স্বত্বই তৈরি হয় না। এ অবস্থায় অগ্রণী ব্যাংক যদি ওই জমি কারও কাছে বিক্রি করতে চায়, তা অবৈধ হবে।

তিন বছর ধরে এই ঋণ নিয়ে বহু ঘটনার জন্ম নিয়েছে অগ্রণী ব্যাংকে। বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যাংকটির শীর্ষ কর্মকর্তাদের দায়ী করেছে। এমনকি এ জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠিও লিখেছিল। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা তো নেয়নি, উল্টো মিজানুর রহমান খানকে মহাব্যবস্থাপক থেকে ডিএমডি বানিয়েছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তি তোয়াক্কা না করে সৈয়দ আবদুল হামিদের মেয়াদ তিন দফা বাড়িয়েছে।

আইনজীবী তানজীব-উল-আলম এসব বিষয়ে আরও বলেন, ঋণ বিতরণ-প্রক্রিয়াটির গোড়াতেই গলদ। এ ঘটনায় অগ্রণী ব্যাংকের দায়ী ব্যক্তিরা এখন দায় এড়াতে চাইছেন। জমির মালিকানা নিশ্চিত না হয়ে ঋণ বিতরণ করে তাঁরা জনগণের আমানতের অর্থ লুণ্ঠনের বিরল উদাহরণ তৈরি করেছেন।

মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা হয় ২০১১ সালে। এর আগে ও পরে মিরপুর মডেল থানায় তাঁর বিরুদ্ধে সাতটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন আবদুল গণি। জিডিগুলোতে বলা হয়, ভবনটির নির্মাণকাজ বন্ধে যতবারই তিনি বাধা দিতে গিয়েছেন, ততবারই মিজানুর রহমান ও তাঁর লোকেরা প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছেন।

শেখ মো. আবদুল গণি মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৬৬ সালের ভুয়া খারিজ ও ১৯৯১ সালের ভুয়া দলিল দিয়ে মিজানুর রহমান আমাদের জমি দখল করেছেন। প্রতিকার চেয়ে আমরা আদালতে মামলা করেছি। মুন গ্রুপকে ঋণ না দিতে অগ্রণী ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে লিখিতভাবে জানিয়েও ঠেকাতে পারিনি।’

বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি নিয়ে ২০১৩ সালের আগস্টে তদন্তে নামে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘জমির প্রকৃত দলিল নেই, মিজানুর রহমানের আগে জমির যিনি মালিক ছিলেন তাঁর নামে খারিজের প্রমাণপত্র নেই, ঋণের জামানত নেই, এমনকি ভবনের নকশাও রাজউক অনুমোদিত নয়।’ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘মুন গ্রুপের অভ্যাস হচ্ছে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়া। এত সব জেনেও গ্রুপটিকে ঋণ দিতে বেশি মনোযোগী ছিল অগ্রণী ব্যাংক।’

এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এরপর ২০১৪ সালের জুনে এক চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ আবদুল হামিদ ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মিজানুর রহমান খানকে জনগণের আমানতের বিপুল পরিমাণ টাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ করার জন্য সরাসরি দায়ী করে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, মুন বাংলাদেশের নামে অনেক অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। মিজানুর রহমান বিপুল পরিমাণ অর্থ তাঁর ব্যক্তিগত হিসাবে সরিয়েছেন। অথচ অগ্রণী ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগকে তা জানায়নি।

অগ্রণী ব্যাংকের এমডি যেহেতু অর্থ মন্ত্রণালয়ের সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত, বাংলাদেশ ব্যাংক তাই গত মে, জুন ও জুলাইয়ে তিন দফা চিঠি দিয়ে এমডি ও এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে।

চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এমডির জ্ঞাতসারে ও প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে প্রধান শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন একটি চক্র আমানতকারীদের ৩০০ কোটি টাকা ঝুঁকিগ্রস্ত করেছে।

সৈয়দ আবদুল হামিদের বক্তব্য জানতে গত মঙ্গলবার অগ্রণী ব্যাংকে গেলে এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘খুবই ব্যস্ত আছি। কথা বলতে পারছি না।’ অবশ্য গত রোববার ব্যাংকের ডিএমডি মিজানুর রহমান খান এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকের টাকা আদায়ের পদক্ষেপ হিসেবে আমরা মুন বাংলাদেশের সম্পদ নিলামে তুলেছি। এরপর মামলায় যাব।’

প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় মুন বাংলাদেশ লিমিটেড ঋণই পেতে পারে না এবং টাকা ফেরত পাওয়া যাবে না—জেনেশুনেই ঋণ দেওয়া হয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমডি শুধু বলেন, ‘এটা কি সম্ভব?’

ঋণ বিতরণকালীন ব্যাংকের চেয়ারম্যান খন্দকার বজলুল হককে মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি। বর্তমান চেয়ারম্যান জায়েদ বখ্ত প্রথম আলোকে জানান, আইনি মতামত নিয়েই সম্পত্তি নিলামে তোলা হয়েছে। এ ব্যাপারে অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন সেই সময়ের পর্ষদ সদস্য হিসাববিদ (সিএ) গোলাম কিবরিয়া।

কীভাবে এতগুলো টাকা চলে গেল এবং আপনিই কী দায়িত্ব পালন করেছেন, জানতে চাইলে জনাব কিবরিয়া বলেন, ‘ওই সময়ে সবাই মিলে বলল, মুন গ্রুপকে ঋণ দেওয়া যায়। আজ কী দেখা যাচ্ছে? আসলে পর্ষদে বিশদ কিছু তোলা হয় না। তারপরও আমার বারবারই মনে হচ্ছিল এ ঋণ দেওয়া যায় না, দিলে টাকা ফেরত আসা কঠিন হবে। আমি সাতবার সাত বৈঠকে এ নিয়ে আপত্তি তুলেছি। দু-একজন সমর্থনও করেছিল আমাকে। পরে কোন অদৃশ্য শক্তিতে, কীভাবে, কী হলো বলতে পারব না।’

 অন্য একটি মামলায় আসামি হয়ে মুন গ্রুপের মিজানুর রহমান কারাগারের অধীনে কয়েক মাস ঢাকা মেডিকেলে থেকে বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন আছেন।

অগ্রণী ব্যাংক মুন ইন্টারন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেসের নামেও ৪৯ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। সেটারও নিলাম ডাকা হয়েছে। ব্যাংকের কাছে এ গ্রুপের মোট ঋণ ৩০০ কোটি টাকারও বেশি। সাউথ বাংলা এগ্রিকালচারাল ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন মিজানুর রহমান। ব্যাংকের পর্ষদ তাঁকে এ পদ থেকে অব্যাহতি দেয়।

উল্লেখ্য, মিজানুর রহমানের প্রতিষ্ঠান এম আর ট্রেডিং রাজধানীর দিলকুশায় সরকারি জমির ওপর ‘সানমুন স্টার টাওয়ার’ নামে ৩০ তলা আরেকটি ভবন তৈরি করেছিল। সে ক্ষেত্রেও পদে পদে অনিয়ম-দুর্নীতি নির্মাণে আইন, বিধি, নীতিমালা—কোনোটাই মানা হয়নি। নেওয়া হয়নি সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থার অনুমোদন। ওই ভবনটি নিয়েও এখন মামলা চলছে।