শত বছরে আবার ফুটবে 'মরণফুল'!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের বাগানে তালিপামের চারার পরিচর্যা করছেন মালি l প্রথম আলো
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের বাগানে তালিপামের চারার পরিচর্যা করছেন মালি l প্রথম আলো

‘মরণফুল’ ফোটার পর আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গাছটি। কারণ সেটিই ছিল বিশ্বে ওই প্রজাতির একমাত্র গাছ। ফলের বীজ থেকে চারা পাওয়ার সম্ভাবনা তেমন না থাকলেও জন্মেছিল চারা। সেই চারা বড় হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়ে বংশবিস্তার হচ্ছে দুর্লভ তালিপাম গাছের। বেঁচে থাকলে শত বছরে আবার ফুটবে তালিপামের সেই ‘মরণফুল’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবরিকালচার দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বছর চারেক আগেও পৃথিবীর একমাত্র তালিপামগাছটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ফুলার রোডে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্যের বাসভবনের সামনে সেই গাছটিতে ফুল ফোটে ২০০৮ সালে। তালিপামের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, শত বছরের মধ্যে একবার ফুল ধরে গাছে। সেই ফুলই হয় ‘মরণফুল’। অর্থাৎ একবার ফুল দিয়েই মারা যায় গাছ। ২০০৮ সালে ফুল হওয়ার পর ২০১০ সালে মারা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছটি। তখন এর ফল সংগ্রহ করে প্রায় পাঁচ শ চারা তৈরি করতে সক্ষম হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকে তিন শর মতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক হাদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ফুলার রোডের তালিপামটিতে ফুল ফোটার পর আমরা আশঙ্কা করেছিলাম পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে গাছের এ প্রজাতিটি। কারণ ফুল ফোটার পরপরই গাছটি মারা যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ীও এ গোত্রের প্রজাতিগুলোর বীজও সচরাচর অঙ্কুরিত হয় না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে এ তালিপামগাছটির সব বীজ থেকে চারা হয়।
আরবরিকালচার দপ্তরের জ্যেষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফেকুলাল ঘোষ বলেন, তালিপামের ফল থেকে টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে চারা করতে গিয়ে ব্যর্থ হন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সহ-উপাচার্যের বাসভবনের মালি জাহাঙ্গীর আলম বীজ রোপণ পদ্ধতিতে চারা তৈরিতে সক্ষম হন। গাছটি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার পেছনে তাঁর অবদানই বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জন্মানো শ তিনেক চারার মধ্যে ২০১০ সালে বিতরণ করা হয় ১২০টি চারা। এর মধ্যে ১০০ চারা দেওয়া হয় বন বিভাগকে। এ ছাড়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে সাতটি, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতটি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি, বেইলি রোডের সামাজিক বন বিভাগকে দুটি করে চারা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে লাগানো দুটি চারা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, গাছ দুটি পাতাসহ প্রায় চার ফুটের মতো লম্বা হয়েছে। সবুজ ডাঁটাসহ পাতাগুলো বেড়ে উঠেছে কেবল। গোড়া বা কাণ্ড হয়ে ওঠেনি।
ফেকুলাল ঘোষ মনে করেন, গাছটির চারা সারা দেশে যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, এগুলোতেও একসময় ফুল ফুটবে, ফল হবে। মানুষ সচেতন থাকলে ধীরে ধীরে ‘বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি’র তালিকা থেকে গাছটি মুক্তি পাবে।
তালিপাম দেখতে প্রায় তালগাছের মতো হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি একটি ভিন্ন প্রজাতি। এই প্রজাতিটি প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯১৯ সালে। ব্রিটিশ অরণ্যতরু সন্ধানী উইলিয়াম রক্সবার্গ ভারতের পূর্বাঞ্চলে এই প্রজাতির গাছের সন্ধান পান। তিনি এর নাম দেন ‘করিফা তালিয়েরা’ (Corypha taliera)। রক্সবার্গের নাম জুড়ে দিয়ে পরে এর বৈজ্ঞানিক নামকরণ করা হয় ‘কারিফা তালিয়েরা রক্সবার্গ’। বাংলায় গাছটিকে ‘তালি’ বা ‘তালিপাম’ নামে ডাকা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এ গাছটি প্রথম শনাক্ত করেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী শ্যামল কুমার বসু।