চুয়াডাঙ্গায় বাউল উৎসবের আয়োজককে কুপিয়ে হত্যা

চুয়াডাঙ্গায় বাউল উৎসব চলাকালে উৎসবস্থলের কাছেই অনুষ্ঠানের প্রধান আয়োজককে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত পৌনে ১২টার দিকে সদর উপজেলার আলোকদিয়া ইউনিয়নের আকন্দবাড়িয়া গ্রামের নাগুড়তলা মাঠে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। এর মাত্র পাঁচ শ গজ দূরে আকন্দবাড়িয়া গুচ্ছগ্রামের ফকির বাগানে চলছিল বাউল উৎসব।
নিহত ব্যক্তির নাম জাকারিয়া হোসেন ওরফে জাকির (৩০)। তিনি আকন্দবাড়িয়া গ্রামের গাঙপাড়ার বাসিন্দা। তাঁর প্রয়াত বাবা ফকির ফজলু শাহ চুয়াডাঙ্গার সুপরিচিত বাউলশিল্পী ছিলেন।
পুলিশ রাতেই লাশ উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় নেয় এবং গতকাল শুক্রবার সকালে সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল রাতে আকন্দবাড়িয়া কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়।
পুলিশ জাকারিয়া খুনের ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে রাশেদ (৩০) নামের এক ভ্যানচালককে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। রাশেদ মেহেরপুর সদর উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের দরবেশপুর গ্রামের বাসিন্দা।
রাশেদের বরাত দিয়ে পুলিশ বলেছে, ১০ থেকে ১২ জন সন্ত্রাসী অতর্কিত হামলা করে জাকারিয়াকে হত্যা করেছে।
আকন্দবাড়িয়ার বাসিন্দা, উৎসবে যোগ দেওয়া বাউলশিল্পী ও নিহত জাকারিয়ার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাকারিয়ার বাবা ফকির ফজলু শাহ প্রতিবছর গ্রামে বাউল উৎসবের (বাউল সম্প্রদায় যাকে বলে ‘সাধুসঙ্গ’) আয়োজন করতেন। তিন বছর আগে তিনি মারা যান। গুচ্ছগ্রাম ফকির বাগানে তাঁকে কবর দেওয়া হয়। সেখানকার ‘মাজার চত্বরে’ প্রতিবছর ফজলু শাহের মৃত্যুবার্ষিকীতে ছেলে জাকারিয়া সাধুসঙ্গের আয়োজন করে আসছিলেন। বৃহস্পতিবার ছিল ফজলু শাহর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে এবারও সাধুসঙ্গের আয়োজন করা হয়েছিল।
জাকারিয়ার স্ত্রী সালমা খাতুন গতকাল প্রথম আলোকে জানান, জাকারিয়া বাউল উৎসব নিয়ে কয়েক দিন ধরেই ব্যস্ত ছিলেন। উৎসবের কারণে বেশ কিছুদিন পানের ব্যবসা করতেও যাননি। বাউল সাধুদের সন্তুষ্টি নিয়েই সারাক্ষণ ছিল তাঁর চিন্তা। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনি উৎসবস্থল থেকে মোটরসাইকেলে বাড়িতে আসেন। এরপর বাউলদের জন্য কয়েকটি লেপ-কাঁথা নিয়ে একটি ভ্যানে করে ফকির বাগানের উদ্দেশে রওনা দেন। ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর তাঁর খুনের খবর আসে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে জেলার জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মো. ছুফি উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, খুনের ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ভ্যানচালক রাশেদকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। রাশেদ তাঁদের বলেছেন, তাঁরা উৎসবস্থলে যাওয়ার সময় ১০ থেকে ১২ জন দুর্বৃত্ত ভ্যান থামিয়ে জাকারিয়াকে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যায়। এর বেশি রাশেদ কিছুই জানাতে পারেননি বলে ওই কর্মকর্তা জানান। তিনি বলেন, খুনের কারণ জানতে অনুসন্ধান চলছে।
গতকাল নিহত জাকারিয়ার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের যখন কথা হচ্ছিল, তখন স্ত্রী সালমা খাতুনের কোলে দুই বছর বয়সী শিশু সিয়াম বারবার কেঁদে কেঁদে বলছিল, ‘বাবার কাছে যাব, বাবার সাথে মোটরসাইকেলে ঘুরতে যাব।’ জাকারিয়ার বৃদ্ধা মা ফিরোজা বেগম (৭০) কাঁদতে কাঁদতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন।
উৎসবে যোগ দেওয়া কয়েকজন বাউলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের উৎসবে দুই শতাধিক বাউলের সমাবেশ ঘটেছিল। ছিলেন কয়েক শ ভক্ত-অনুরাগী দর্শক। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাধুসঙ্গ শুরু হয়। রাতভর গান শেষে গতকাল দুপুরে উৎসব শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতের খুনের ঘটনার পর গানবাজনা বন্ধ হয়ে যায়।
আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা চুয়াডাঙ্গা জেলা বাউল কল্যাণ সংস্থার কোষাধ্যক্ষ আকন্দবাড়িয়া গ্রামের আবদুল মোতালেব শাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি একটি পরিকল্পিত খুনের ঘটনা। এই খুনের ঘটনায় বাউল সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ। আমরা খুনিদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’
জেলা বাউল কল্যাণ সংস্থার সভাপতি সদর উপজেলার শৈলগাড়ির ফকির মহিউদ্দিন শাহ বলেন, শনিবার (আজ) বাউল সাধুদের ডেকে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম জানান, খুনের ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।