মোস্তফা সেলিমের নাগরিপ্রেম

প্রবীণ পুঁথিপাঠক আনফর আলী সম্প্রতি পুঁথি সংগ্রাহক মোস্তফা সেলিমের হাতে একখানা নাগরি পুঁথি তুলে দেন l প্রথম আলো
প্রবীণ পুঁথিপাঠক আনফর আলী সম্প্রতি পুঁথি সংগ্রাহক মোস্তফা সেলিমের হাতে একখানা নাগরি পুঁথি তুলে দেন l প্রথম আলো

নাগরি লিপি। বাংলা বর্ণমালার আরেকটি বিকল্প বর্ণমালা। সিলেট অঞ্চলের অসংখ্য ফকির-সাধক-পীর-দরবেশ নাগরি লিপির সাহায্যে প্রায় ছয় শ বছর আগে বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য রচনা করেছেন। এমনকি কোরআন শরিফ থেকে শুরু করে নবীর জীবনী—সবই রচিত হয়েছে নাগরি লিপিতে। স্থানীয় লোকজনের মধ্যেও ছিল নাগরি সাহিত্য পঠনপাঠনের চর্চা।
এখন সেটা একেবারেই ধূসর অতীত, বিলুপ্ত এক অধ্যায়। এমনকি কয়েক শ বছরের পুরোনো যেসব নাগরি পাণ্ডুলিপি ও প্রকাশিত পুঁথি রয়েছে, সেগুলোও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। সেসব প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহে এগিয়ে এলেন এক সংগ্রাহক। ঐতিহ্যসচেতন এই মানুষটি হলেন মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার ইটাউরি গ্রামের ৪৫ বছর বয়সী মোস্তফা সেলিম।
প্রায় এক দশক ধরে প্রাচীন পুঁথির সন্ধানে মোস্তফা সেলিম ঘুরে বেড়াচ্ছেন সিলেটের এ–গ্রাম থেকে ও–গ্রামে। ইতিহাস-ঐতিহ্যনির্ভর প্রাচীন বইপুস্তক ও পুঁথি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ছেড়েছেন শিক্ষকতা। তবে কেবল সংগ্রহের মধ্যেই তাঁর কাজ সীমাবদ্ধ থাকেনি। এসব নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে প্রাচীন পুঁথিগুলো প্রকাশের পাশাপাশি ‘ফিরে দেখা সিলেটি নাগরি’ শীর্ষক একাধিক প্রচারণামূলক অনুষ্ঠানও করছেন।
যেভাবে নাগরিপ্রেম: মেধাবী ছাত্র মোস্তফা সেলিম ১৯৮৬ সালে এসএসসি পাস করে সিলেটের মদন মোহন কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন। তখনই সিলেটের ঐতিহ্যবাহী নাগরি লিপির বিষয়টি জানতে পারেন। সিলেটের এমসি কলেজের গণিত বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন এরহাসুজ্জামান। ওই শিক্ষক তাঁর কলেজের শিক্ষার্থীদের ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে নাগরি লিপি হাতে-কলমে শেখাতেন। বিষয়টি মোস্তফা সেলিম তাঁর বন্ধুদের কাছে শুনেছিলেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী মোস্তফা সেলিম বড়লেখা উপজেলার ইটাউরি হাজী ইউনুছ মিয়া মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন ১৯৯৬ সালে। এ সময় তাঁর হাতে আসে ১৯১০ সালে প্রকাশিত অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি রচিত সিলেটের ইতিহাসনির্ভর প্রথম গ্রন্থ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্তসহ আরও দুর্লভ এবং প্রাচীন বেশ কিছু বই। দুর্লভ বইগুলোর বিলুপ্তি ঠেকাতে তিনি সেসব সংগ্রহের কাজে নেমে পড়েন। পাশাপাশি নিজেও স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে লিখতে থাকেন এবং তখনই প্রকাশিত হয় তাঁর রচিত মুক্তিযুদ্ধে বড়লেখা এবং বড়লেখা অতীত ও বর্তমান (যৌথ সম্পাদনা) গ্রন্থগুলো।
একপর্যায়ে তাঁর সংগ্রহে সিলেটের বেশ কিছু প্রাচীন বইয়ের সংগ্রহ দাঁড়ায়। এসব তিনি প্রকাশ করে পাঠকের হাতে তুলে দিতে শিক্ষকতা ছেড়ে ২০০১ সালের দিকে ঢাকায় গিয়ে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাচীন বইগুলো একের পর এক প্রকাশ হতে থাকে।
নাগরি লিপির উৎস সন্ধান: বাংলা ভাষার প্রচলিত বর্ণমালার বাইরে একটি পৃথক বর্ণমালা সিলেট অঞ্চলে প্রচলিত হয়েছিল চতুর্দশ শতাব্দীতে। ইসলামি নানা কাহিনি, ধর্মের বাণী, সুফিবাদ ও ফকিরি গান রচনা থেকে শুরু করে দলিল-দস্তাবেজ ও হিসাব-নিকাশে অধিকাংশ সিলেটি তখন নাগরি লিপি ব্যবহার করতেন। সিলেট ছাড়াও কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, ভৈরব এবং ভারতের করিমগঞ্জ, শিলচর ও আসামে এ লিপির ব্যবহার ছিল। তবে ৫০ থেকে ৬০ বছর আগে এ লিপির ব্যবহার ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে আসে।
বাংলা ভাষার বিকল্প এ লিপির বর্ণসংখ্যা ৩২। বর্ণনাম এবং উচ্চারণ হুবহু বাংলার মতো। নাগরি বর্ণমালায় একই উচ্চারণে একাধিক বর্ণ পরিহার করা হয়েছে। এ লিপির ব্যবহার সিলেট অঞ্চলে মূল বাংলা লিপিতে সাহিত্য রচনার চেয়ে একসময় বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৫৪৯ সালে গোলাম হোসেনের তালিব হুসন বইটিই এ লিপিতে লিখিত প্রথম গ্রন্থ। ১৮৬০ সালে নাগরি লিপির মুদ্রণ শুরু হলে এর সাহিত্যিক আবেদন সিলেট অঞ্চলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ ধারা মধ্য বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত চলমান ছিল। তখন কলকাতা, শিলচর, সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন ছাপাখানা থেকে নাগরি লিপিতে রচিত পুঁথি প্রকাশিত হতো।
দেশভাগের পর নাগরি লিপির ব্যবহার হ্রাস পেতে থাকে। তখন সিলেট শহরের বন্দরবাজার এলাকার ইসলামিয়া প্রেস থেকে নাগরি পুঁথি প্রকাশিত হতো। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা ওই ছাপাখানায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটালে নাগরি লিপির পুঁথি প্রকাশ ও চর্চা পুরোপুরিই বিলুপ্ত হয়।
নাগরির সুলুক সন্ধানে: নাগরি সাহিত্যের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহে মোস্তফা সেলিম চষে বেড়াতে শুরু করলেন সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে। তাঁর এ সংগ্রহকাজে সহযোগিতা করেন মো. জিয়াউল ইসলাম এবং আইনজীবী মঈনুল ইসলাম। সহযোগিতা পেয়েছেন আরও বহু জনের। এ মাসের প্রথম সপ্তাহে সিলেট সদর উপজেলার পীরের বাজারের প্রবীণ পুঁথিপাঠক আনফর আলী তাঁর সংগ্রহে থাকা একখানা নাগরি পুঁথি খুশিমনে মোস্তফা সেলিমের হাতে তুলে দিয়েছেন।
নাগরি সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন: পুঁথিগুলো সংগ্রহ করে সেলিম থেমে থাকেননি। নিজের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘উৎস প্রকাশন’ থেকে তা প্রকাশের উদ্যোগও নেন। তবে শুরুতেই সমস্যায় পড়েন কম্পিউটারে নাগরি লিপি কীভাবে লিখবেন তা নিয়ে। দ্বারস্থ হন প্রকৌশলী মো. আবদুল মান্নানের। মান্নান কম্পিউটারে নাগরি ফন্ট উদ্ভাবন করে এটির নাম দিলেন ‘ফুল নাগরি’। তবে কেবল নাগরি লিপিতে এসব পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হলে সাধারণ মানুষ কিছুই বুঝতে পারবেন না ভেবে সেসব পুঁথি ও পাণ্ডুলিপি বাংলায় লিপ্যন্তরেরও উদ্যোগ নেন।
২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস নাগরি সাহিত্যের ইতিহাসে এক নতুন ঊষাকাল রচিত হয়। মোস্তফা সেলিম ও মো. আবদুল মান্নানের সম্পাদনায় বাংলায় লিপ্যন্তরসহ বেরোয় কেতাব হালতুন্নবী পুঁথি। প্রথম প্রকাশের ১৪৭ বছর পর মুন্সি সাদেক আলী রচিত নবী জীবনের আখ্যাননির্ভর এ পুঁথিটি পুনরায় পাঠকের হাতে পৌঁছায়।
মোস্তফা সেলিম জানান, নাগরি লিপিতে দেড় থেকে দুই শতাধিক পুঁথি রচিত হয়েছে বলে গবেষকদের ধারণা। এর ভেতরে প্রায় এক শ পুঁথি তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে। আরও ২৫টি পুঁথি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। বাকি পুঁথি পর্যায়ক্রমে প্রকাশ করা হবে। সিলেটি নাগরি লিপি বর্ণ পরিচয় শীর্ষক একটি বই রচনা করেও প্রকাশ করেছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
কী বলেন বিশিষ্টজনেরা: দেশের বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও গবেষক হায়াৎ মামুদ বলেন, ‘বাংলা বর্ণমালার বাইরেও আমাদের দেশে আরেকটি বিকল্প বর্ণমালা চালু ছিল, এটি অত্যন্ত সুখবর। সিলেট অঞ্চলের অধিবাসীরা একসময় এ লিপিতে অনেক সাহিত্য রচনা করেছেন, সেগুলো সংগ্রহ করে মোস্তফা সেলিম বই আকারে প্রকাশ করে একটি বিলুপ্ত সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। তার এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই।’
বৃহত্তর সিলেট ইতিহাস প্রণয়ন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শুভেন্দু ইমাম বলেন, ‘নাগরি লিপিতে রচিত পুঁথিগুলো বাংলায় লিপ্যন্তর করে প্রকাশিত হওয়ায় সাধারণ পাঠকেরা এর রস আস্বাদন করতে পারছেন।’
আছে আক্ষেপ, আছে স্বপ্ন: নাগরি সাহিত্যের অনুসন্ধানে সেলিম কাটিয়ে দিয়েছেন ১০টি বছর। তিনি বলেন, ‘নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। প্রচুর টাকা খরচ হয়ে যাওয়ায় একসময় হতাশ হয়ে পড়লেও মুষড়ে পড়িনি।’
মোস্তফা সেলিম আরও বলেন, ‘সিলেটে একটি নাগরি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছি। আগামী বছর এ জাদুঘরের কার্যক্রম শুরু হবে। বিলুপ্তপ্রায় নাগরি পাণ্ডুলিপি ও পুঁথিগুলোও ওই জাদুঘরে থাকবে এবং এই লিপি ও সাহিত্যের সঙ্গে ছয় শ বছর ধরে যেসব ব্যক্তি সম্পৃক্ত ছিলেন, তাঁদেরও নানা ধরনের স্মৃতি ও আলোকচিত্র থাকবে।’