শাহরাস্তিতে ব্যবস্থাপত্র যায় রোগীর কাছে

শাহরাস্তি উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মানিক লাল মজুমদার স্কাইপের মাধ্যমে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের ইউনিয়নের ডিজিটাল সেন্টারে আসা রোগীর সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থাপত্র লিখছেন। ছ​ি​বটি ২১ এপ্রিল তোলা l এম সাদেক
শাহরাস্তি উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মানিক লাল মজুমদার স্কাইপের মাধ্যমে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের ইউনিয়নের ডিজিটাল সেন্টারে আসা রোগীর সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থাপত্র লিখছেন। ছ​ি​বটি ২১ এপ্রিল তোলা l এম সাদেক

চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মানিক লাল মজুমদার হাসপাতালে কম্পিউটারের সামনে বসে দক্ষিণ মেহের ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তাকে বললেন, ‘রোগী কে? রোগীকে দাও।’
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মানিক লালের সামনে থাকা কম্পিউটারে ভেসে উঠল এক যুবকের মুখ। ওই যুবক বসে আছেন কয়েক কিলোমিটার দূরে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের স্কাইপের সামনে। মানিক লাল জিজ্ঞেস করলেন, ‘নাম কী?’ যুবক বললেন, ‘মো. শাহ আলম।’ মানিক লাল বয়স জানতে চাইলেন। যুবক বললেন, চব্বিশ। এরপর চিকিৎসক বলেন, ‘আপনার সমস্যা বলেন?’ শাহ আলম বলেন, ‘কোমরে ব্যথা।’
একের পর এক প্রশ্ন করেন মানিক লাল, ওপাশ থেকে উত্তর দেন রোগী। চিকিৎসক কাগজে নোট নেন। শেষ পর্যায়ে চিকিৎসক রোগীকে বলেন, ‘উদ্যোক্তার কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে বাড়ি যাবেন।’ ওপার থেকে উত্তর আসে, ‘জি স্যার।’
এরপর মানিক লাল ওই যুবকের নামে ব্যবস্থাপত্র লেখেন। ব্যবস্থাপত্রটি সঙ্গে সঙ্গে স্ক্যান করে দক্ষিণ মেহের ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রে পাঠিয়ে দেন হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। মানিক লালের দাবি, ‘এভাবে প্রেসক্রিপশন দেওয়ার নজির সম্ভবত কোথাও নেই।’ দিনটি ছিল সোমবার, ১১ এপ্রিল। তবে শাহরাস্তিতে এই সেবা চালু হয়েছে কয়েক মাস আগেই।

 ‘সরকারি হাসপাতালে সম্প্রসারিত হচ্ছে টেলিমেডিসিন চিকিৎসাসেবা’ শীর্ষক চার পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। প্রতিবেদনে ৬৯টি সরকারি হাসপাতালের তালিকা দেওয়া আছে। এতে ৪২টি উপজেলা হাসপাতালের কথা বলা হয়েছে। এসব হাসপাতালে বর্তমানে টেলিমেডিসিন সেবা চালু রয়েছে। এই উপজেলা হাসপাতালগুলোতে জটিল রোগী এলে স্কাইপের মাধ্যমে তাঁদের জেলা বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয়। 

এই তালিকায় চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নাম নেই। শাহরাস্তির চিকিৎসকেরা নিজেদের উদ্যোগেই ‘টেলিমেডিসিন’ সেবা চালু করেছেন। এর সঙ্গে যুক্ত করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তাদের।

সরকার এটুআই (এক্সেস টু ইনফরমেশন) কর্মসূচির মাধ্যমে সারা দেশে ৪ হাজার ৫৫০টি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করেছে। প্রতিটি ডিজিটাল সেন্টারে দুজন করে ‘উদ্যোক্তা’ কাজ করেন। একজন নারী, একজন পুরুষ। সরকার দিয়েছে জায়গা ও কিছু সরঞ্জাম। সরকারের দেওয়া এই সুযোগ ব্যবহার করে উদ্যোক্তারা স্থানীয় মানুষকে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে নানা ধরনের সেবা দেন। এই সেবার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফরম পূরণ করে দেওয়া, জমির পর্চা তুলে দেওয়া, বিদ্যুৎ বিল দেওয়া, মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দেওয়া ইত্যাদি। এই উদ্যোক্তাদের সঙ্গে নিয়ে শাহরাস্তি উপজেলা হাসপাতালের চিকিৎসকেরা সেবা দেওয়ার নতুন পন্থা বের করেছেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বয়স, ব্যস্ততা, দূরত্ব—এসব কারণে যাঁরা হাসপাতালে আসতে পারেন না বা চান না, তাঁদের মানসম্পন্ন সেবা দিতেই এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছি।’

দেশের আর দশটি উপজেলা হাসপাতালের চেয়ে শাহরাস্তির এই হাসপাতাল যেন একটু আলাদা। কে কোথায় কোন সেবা পাবেন, হাসপাতালে কোন ওষুধ আছে, কোনটি নেই, তা জানার জন্য বড় বড় সাইনবোর্ড, ব্যানার টানানো। হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আছে বিশেষ উদ্যোগ। হাসপাতালে আসা নারী ও পুরুষ দর্শনার্থীদের জন্য আছে পৃথক হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। আছে নিরাপদ খাবারের ব্যবস্থা। 

মানিক লাল মজুমদার বলেন, ‘সরকার আমাদের ল্যাপটপ দিয়েছে, তাতে স্কাইপে নম্বর আছে। অন্যদিকে ১০টি ইউনিয়নে ১০টি তথ্যকেন্দ্র আছে, প্রতিটি কেন্দ্রে প্রত্যেকের স্কাইপে নম্বর আছে। আমি ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রগুলোকে হাসপাতালের কাজে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে থাকি। তথ্যকেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলি। তাঁদের সঙ্গে স্কাইপে যোগাযোগ করতে বাড়তি বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। হেডফোনসহ ছোটখাটো সরঞ্জাম চিকিৎসকেরা নিজেদের টাকায় কিনে নিয়েছেন।’

চাঁদপুর জেলা ও শাহরাস্তি উপজেলার সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দূরের মানুষকে সেবা দেওয়ার বিষয়টি এই উদ্যোগে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। যাঁরা হাসপাতালে আসতে পারেন না, তাঁরা অনেকে অপচিকিৎসার শিকার হন। অনেকে সেবা নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা কী হবে, তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা হয়। কারণ যে উদ্যোগই নেওয়া হোক না কেন, তা থেকে ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের আর্থিক লাভ হতে হবে।

এ নিয়ে সভা হয় উপজেলা সদরে। উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাতে অংশ নেন। সিদ্ধান্ত হয়, প্রতিটি ব্যবস্থাপত্রের জন্য উদ্যোক্তা পাবেন ২০ টাকা। কাগজ আর ইন্টারনেট বাবদ তাঁদের বড়জোর খরচ হয় পাঁচ টাকা। সুতরাং আর্থিক লাভের জন্য তাঁরা এই সেবায় যুক্ত হবেন। প্রশ্ন ওঠে, উদ্যোক্তাদের দেওয়ার টাকাটা আসবে কোথা থেকে? স্থানীয় সরকারের তহবিল থেকে তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

‘একটা চমৎকার জিনিস তারা তৈরি করেছে। রোগী ডাক্তারের ছবি দেখতে পারছে, ডাক্তার রোগীর ছবি দেখছে। তাদের মধ্যে কথা হচ্ছে। এরপর ডাক্তার ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছে।’ এভাবেই স্থানীয় ডাক্তারদের উদ্ভাবন নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে মন্তব্য করলেন শাহরাস্তি উপজেলা চেয়ারম্যান দেলওয়ার হোসেন মিয়াজী। তিনি বলেন, এই সেবা দেওয়ার জন্য যে খরচ হবে, তা উপজেলা পরিষদের তহবিল থেকে উদ্যোক্তাদের পরিশোধ করা হবে—এমন সিদ্ধান্ত সভা করে নেওয়া হয়েছে।

  উনকিলা গ্রামটি রায়শ্রী উত্তর ইউনিয়নে। এই ইউনিয়নের তথ্যকেন্দ্রের উদ্যোক্তা আনোয়ারা হোসেন। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ৩০ জন রোগীকে তিনি স্কাইপের মাধ্যমে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। তবে এখন পর্যন্ত রোগী দেখানো বাবদ কোনো অর্থ বা ফি তিনি পাননি। তবে বিল ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলা থেকে পরিশোধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে তিনি জানেন। 

১০টি ইউনিয়নের তথ্যকেন্দ্রের সামনে এই দূর চিকিৎসার ব্যানার টানানো আছে। তাতে বলা আছে, রোগী সপ্তাহে কোন দুই দিন এই সেবা পাবেন। মানিক লাল বলেন, ‘অন্যদিকে আমরা চিকিৎসকেরা রোস্টার করে নিয়েছি। কে কোন দিন স্কাইপের সামনে বসব, তা ঠিক করা থাকে। এক দিনে দুটি তথ্যকেন্দ্রের রোগীকে এই সেবা দেওয়া হয়।’

 আবুল হাসেম শারীরিক প্রতিবন্ধী। বয়স ৫৯ বছর। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে যাওয়ার চেয়ে কম্পিউটারে ডাক্তার দেখানো ভালো। যাওয়ার কষ্ট নাই, সময় নষ্ট হয় নাই। যাইতে-আসতে যে খরচ, সেটাও লাগে নাই।’ আবুল হাসেম আরও বলেন, ‘কম্পিউটার থেকে ডাক্তারের স্লিপ (ব্যবস্থাপত্র) বার হইছে, সেই নিয়মে ওষুধ কিনে খাইতাছি।’

শাহরাস্তিতে এই বিশেষ সেবার উদ্বোধন করেছিলেন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক আবদুস সবুর মণ্ডল। মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী জুনের মধ্যে চাঁদপুর জেলার সবগুলো উপজেলা হাসপাতালে এই সেবা চালু করার পরিকল্পনা আমাদের আছে।’