সংসদের হাতে অপসারণ ক্ষমতা ইতিহাসের দুর্ঘটনা

.
.

সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী বলে ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট বিভাগ। গতকাল বৃহস্পতিবার দেওয়া এক রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, সংসদের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের পদ্ধতি ইতিহাসের দুর্ঘটনামাত্র, যদিও এটা বিশ্বের কোনো কোনো দেশে বিদ্যমান।
বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এই রায় ঘোষণা করেন। আদালত বলেছেন, সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগকে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক রাখার যে বিধান রয়েছে, এই সংশোধনী সেই বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ও ক্ষমতার পৃথককরণ নীতির পরিপন্থী, তাই এটি সংবিধানে ৭খ অনুচ্ছেদকেও আঘাত করে।
২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল পাস হয়। এতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান বাদ দিয়ে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনা হয়। ওই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন।
গতকাল রায় ঘোষণার শুরুতেই আদালত জানিয়ে দেন, এটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে দেওয়া রায়। আদালতকক্ষে রায়ের অপারেটিভ অংশ পড়ে শোনানো হয়। এতে বলা হয়, বেশির ভাগ কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রে আইনসভার মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণ করা হয় না। ৬৩ শতাংশ কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রে অ্যাডহক ট্রাইব্যুনাল অথবা স্থায়ী শৃঙ্খলা পরিষদের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণ করা হয়। অবশ্যই রাষ্ট্রের প্রধান তিন অঙ্গের মধ্যে ক্ষমতার পৃথক্করণ নীতি সমুন্নত রাখতে তারা এই পদ্ধতি বেছে নিয়েছে।
সংসদ সদস্যদের প্রসঙ্গে আদালত বলেন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সাংসদদের হাত-পা বেঁধে দিয়েছে। সংসদে দলীয় অবস্থানের বিষয়ে প্রশ্ন করার স্বাধীনতা তাঁদের নেই। এমনকি যদি দলীয় সিদ্ধান্ত ভুলও হয়, তাহলেও নয়। তাঁরা দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারেন না। প্রকৃতপক্ষে সাংসদেরা তাঁদের রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারকদের কাছে জিম্মি। ষোড়শ সংশোধনী থাকলে বিচারপতিদের সাংসদ তথা রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে।
শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তি দিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি উন্নত দেশে আইনসভার হাতে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে। রায়ে আদালত এ প্রসঙ্গে বলেন, ওই দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সাংসদদের মেলানো ঠিক হবে না। বাংলাদেশের আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে তাঁদের মৌলিক পার্থক্য আছে, কারণ তাঁরা দায়িত্ব পালনে স্বাধীন।
রায়ে বলা হয়, ‘আমাদের দেশে যে অস্বাভাবিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি চলে আসছে, সেদিকে আমরা চোখ বন্ধ করে রাখতে পারি না। প্রথমত, কোনো জাতীয় ইস্যুতে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য নেই। দ্বিতীয়ত, আমাদের সমাজ সুস্পষ্টভাবে বিভক্ত। তৃতীয়ত, যে দল ক্ষমতায় থাকবে, সেই দলের সব সময় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না-ও থাকতে পারে।’
আইনসভার মাধ্যমে বিচারক অপসারণে শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়ায় সৃষ্টি হওয়া জটিলতার উদাহরণ টেনে আদালত রায়ে বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর ফলে বাংলাদেশেও একই ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। এই মামলার অ্যামিকাস কিউরি ড. কামাল হোসেন বলেছেন, এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগকে হেয় করা হয়েছে এবং নাজুক অবস্থায় ফেলা হয়েছে। আদালতও এই মতের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তাই বিচারপতি অপসারণের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল উত্তম পদ্ধতি।
হাইকোর্ট রায়ে বলেন, এখন কোটি টাকা দামের প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ কি মনে করে যে ষোড়শ সংশোধনী বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করছে? জবাব অবশ্যই হ্যাঁ, মানুষ মনে করে এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নে মানুষের ধারণাকে ব্যাপক গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষের ধারণা হচ্ছে, যদি বিচার বিভাগ স্বাধীন না হয়, তবে তারা টিকে থাকতে পারবে না। এই সংশোধনী বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা নাড়িয়ে দিয়েছে। এতে জনস্বার্থ পিছিয়ে পড়বে, মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রায় আধা ঘণ্টায় রায় ঘোষণা শেষ করেন আদালত। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোতাহার হোসেন। রিট আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ, সঙ্গে ছিলেন সঞ্জয় মণ্ডল।
গত বছরের ২১ মে হাইকোর্টে ষোড়শ সংশোধনী প্রশ্নে দেওয়া রুল শুনানি শুরু হয়েছিল, গত ১০ মার্চ তা শেষ হয়। রুল শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে চারজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর মতামত নিয়েছেন হাইকোর্ট। তাঁরা হলেন ড. কামাল হোসেন, এম আমীর-উল ইসলাম, রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও আজমালুল হোসেন কিউসি। তখন শারীরিক অসুস্থতার জন্য জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মাহমুদুল ইসলাম আদালতে তাঁর মত দিতে পারেননি। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে তিনি মারা যান।
সংক্ষুব্ধ রাষ্ট্রপক্ষ: রায় ঘোষণা শেষে বিকেলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ। আমরা আদালতের কাছে আপিল সার্টিফিকেট (সরাসরি আপিল করার অনুমতি) চেয়েছি, আদালত অনুমতি দিয়েছেন। তবে রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত রাখার জন্য আমরা আগামী রোববার চেম্বার জজের কাছে আবেদন করব।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এই রায়ের ফলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত হয় না।
সংসদের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের পদ্ধতি ইতিহাসের দুর্ঘটনামাত্র—আদালতের এ পর্যবেক্ষণের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘সংবিধানের যেকোনো সংশোধনীকে আদালত অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন, কিন্তু মূল সংবিধানের কোনো বিধানকে অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন না।’
অবশ্য রিট আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ দাবি করেছেন, এই রায়ের ফলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণ পদ্ধতি বহাল হলো। রায়ের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘গত দেড় বছর ধরে আমরা যেখানে আটকে ছিলাম, কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া যেত না, সেই অচলাবস্থা দূর হয়ে গেল। এখন ইচ্ছা করলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।’
অপসারণের ক্ষমতা তিনবার বদল: সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের বিধানে এ পর্যন্ত তিনবার পরিবর্তন করা হয়েছে। বাহাত্তরের সংবিধানে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা ছিল সংসদের হাতে। সংবিধানের ৯৬ (২) অনুচ্ছেদে বলা ছিল, প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদের ভোটে সমর্থিত প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ করা যাবে। আর ৯৬ (৩) অনুচ্ছেদে বলা ছিল, অপসারণের প্রস্তাব-সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। তবে ওই অনুচ্ছেদ অনুসারে আইন আজ পর্যন্ত প্রণীত হয়নি। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত একটি আইনের খসড়া নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে মিন্ত্রসভা।
১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে ৯৬ (২) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সরাসরি রাষ্ট্রপতির হাতে দিয়ে দেওয়া হয়। আর ৯৬ (৩) অনুচ্ছেদটি বিলুপ্ত করা হয়।
১৯৭৭ সালে বিচারকদের অপসারণের পদ্ধতিতে আবার পরিবর্তন আসে। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের এক সামরিক আদেশে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে দেওয়া হয়। এরপর ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এই বিধান সংবিধানে ঢুকে যায়। ২০১০ সালে আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করলেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে অনুমোদন দিয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাহাত্তরের সংবিধানের অনেক বিষয় ফিরিয়ে আনা হলেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাদ পড়েনি। সর্বশেষ ষোড়শ সংশোধনীতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাদ দিয়ে বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ (২) ও (৩) অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনা হয়।

আরও পড়ুন: