ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এত নোংরা!

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২০০ নম্বর ওয়ার্ড। এখানে পরিবেশ কেমন জানতে চাইলে এক রোগীর স্বজন বিছানার চাদরটা তুললেন। কিলবিল করে বেরিয়ে এল একগাদা তেলাপোকা। রোগী এক মাস ধরে ভর্তি। এই এক মাসে বিছানার চাদর বদলানো হয়নি একবারও।

দেশের শীর্ষ এই হাসপাতালে রোগীদের শুধু দিনের পর দিন একই বিছানার চাদরের ওপর থাকতে হচ্ছে তা-ই নয়, থাকতে হচ্ছে ময়লা ও দুর্গন্ধময় পরিবেশে। চার-পাঁচ বছর ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন, এমন রোগী ও হাসপাতালের কমপক্ষে তিনটি বিভাগের চিকিৎসকেরা বলেছেন, আগের চেয়ে পরিবেশ অনেক খারাপ। দুদিন ধরে হাসপাতালে ঘণ্টা চারেক অবস্থান করে মনে হয়েছে, হাসপাতালের এই হালের পেছনে আছে কর্তৃপক্ষের নজরদারি ও রোগীর স্বজনদের অসচেতনতার অভাব। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে এক রোগীর সঙ্গে গড়ে চার-পাঁচজন থাকেন। দর্শনার্থী বেশি। আর রোগীরা বলছেন কর্তৃপক্ষ বেখেয়াল।
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিজানুর রহমান আগের চেয়ে হাসপাতালের পরিবেশ খারাপ হওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আগের চেয়ে অবস্থা খারাপ হয়েছে কথাটা ঠিক নয়। বরং আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। অনেকে এসে প্রশংসাও করছে।’ তিনি বলেন, হাসপাতালে ৮৫০টি পদ ফাঁকা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের শিক্ষক আতিকুল হক বলেন, হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না থাকলে জীবাণু থেকে সংক্রমণ হতে পারে। এই জীবাণুর সংক্রমণ এত ভয়াবহ যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংক্রমিত হলে রোগীরা আর ভালো হন না। কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই ওই রোগীদের ওপর কাজ করে না। তিনি আরও বলেন, নিয়ম অনুযায়ী একজন রোগীর জন্য কমপক্ষে পাঁচ সেট বিছানার চাদর থাকার কথা। বাংলাদেশে প্রতি রোগীর জন্য আছে তিন সেট। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিছানার অতিরিক্ত রোগী থাকায় সবার জন্য তিন সেট চাদরও রাখা সম্ভব হয় না।
ঢাকা মেডিকেলে শয্যাসংখ্যা ২ হাজার ৬০০। প্রতিদিন এখানে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার রোগী ভর্তি থাকে। বহির্বিভাগ ও অন্তর্বিভাগে প্রায় ৩৫ হাজার লোক যাতায়াত করে। হাসপাতালের শৌচাগার পরিষ্কার করা হয় দিনে একবার। শৌচাগারের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় লোকজনকে নাকে কাপড় চেপে স্থানটি দ্রুত পার হতে দেখা গেছে। পুরোনো ভবনের মেঝে ও দেয়াল যেমন নোংরা, বছর তিনেক আগে চালু হওয়া নতুন ভবনেরও একই অবস্থা। ওয়ার্ডের মেঝেতে টিস্যু, তুলা, কাগজের টুকরো, ফলের খোসা ছড়িয়ে আছে। দেয়ালে কফ, থুতু, পানের পিকের ছোপ।
নতুন ভবনের ৬০২ নম্বর ওয়ার্ডে ১৫ দিন ধরে ভর্তি আছেন এক রোগী। আসার পর থেকে তাঁর বিছানার চাদর বদলানো হয়নি। তিনি বলেন, ‘কে পরিষ্কার করব! নিজেরাই বাসা থেকে চাদর নিয়া আসছি।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র বলছে, কেবল নতুন রোগী এলেই বিছানার চাদর পাল্টানো হয়। চাদরটা পাল্টাবে কে, সেই দায় এক কর্মী অন্য কর্মীর ওপর চাপান। এ ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠতলায় ওয়ার্ডের মেঝেতে টিস্যু, তুলা, কাগজের টুকরা পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ৫০২ নম্বর ওয়ার্ডের এক রোগীর স্বজন বলেন, ‘এর মধ্যিই থাকতি হয়।’ এই ভবনে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সকালে একবার ঝাড়ু দিয়ে মুছে দেন আর বিকেলে একবার ঝাড়ু দেন। ভবনের পেছনের দিকে ময়লার স্তূপ।
চিকিৎসকেরা বলেন, সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে দেয়াল ও মেঝে, শৌচাগার ঝকঝকে তকতকে রাখা দরকার। প্রতিদিন বিছানার চাদর বদলানো খুবই প্রয়োজন। নজরদারির অভাবে সে কাজটা ঠিকমতো হয় না। নাক-কান-গলা বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অধ্যাপক বলেন, ‘সারা জীবন দেখে আসছি প্রফেসররা রাউন্ডে যাওয়ার আগেই ওয়ার্ড পরিষ্কার। এখন আমরা যখন রাউন্ড দিতে শুরু করব, তখন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা আসে। কোনোরকমে ঝাড়ু দিয়ে চলে যায়।’ নতুন ভবনের ওয়ার্ড মাস্টার মো. রিয়াজ উদ্দীন বলেন, ‘বিছানা পরিষ্কারের বিষয়টি সিস্টাররা (নার্স) দেখেন।’ আর নার্স মেহেরুন্নেসা বলেন, ‘এটা ওয়ার্ড বয়রা দেখেন। স্টকে থাকলে রোগী চাদর পায়।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক খাজা আবদুল গফুর বলেন, সপ্তাহে একবার বিছানার চাদর বদলানোর নির্দেশ আছে।
রোগীর স্বজনদের যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলা ও খাবার রাখার জন্য তেলাপোকা মেরে শেষ করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের সহকারী পরিচালক খাজা আবদুল গফুর। এত বড় হাসপাতালে মাত্র ২০৮ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী বলেও জানান তিনি।