পাশে কেউ নেই, বাদীই পলাতক!

মো. হানিফ
মো. হানিফ

মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার হোসেন্দী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ছাত্রলীগের নেতা মো. হানিফ নিহত হন। এ ঘটনায় গজারিয়া থানায় ১০৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হলেও কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি। এদিকে আসামিদের হুমকির ভয়ে মামলার বাদীসহ নৌকার প্রার্থীর সমর্থক ১০টি পরিবারের সদস্যরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
হানিফের বাড়ি উপজেলার লস্করদী গ্রামে। গত শুক্রবার সরেজমিনে দেখা যায়, হানিফের (২৭) মা রেজিয়া খাতুন নিজ বসতঘরের দরজার সামনের সিঁড়িতে বসে আছেন। হানিফের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে একজন প্রবাসে থাকেন। অন্য চার ভাই ‘প্রাণনাশের হুমকি’ পেয়ে বাড়িতে থাকেন না। ২৩ মে ওই সংঘর্ষ চলাকালে হানিফের বড় ভাই শরীফ আহত হন। তখন থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। তাঁর মতো লস্করদী গ্রামের আরও প্রায় ১০টি পরিবারের সদস্যরা এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এঁরা সবাই নৌকা প্রার্থীর সমর্থক।

গ্রামের তিনজন বাসিন্দা হানিফদের বাড়ি থেকে প্রায় ৭০০ গজ দূরে লস্করদী বাজারে সংঘর্ষস্থলে নিয়ে যান। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর অস্থায়ী নির্বাচনী প্রচারকেন্দ্র দেখান। টিনের ঘরটিতে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ ছাড়া ১৫টির মতো প্লাস্টিকের ভাঙা চেয়ার পড়ে আছে। পাশেই একটি গ্যারেজের টিনেও কোপানোর চিহ্ন রয়েছে। হানিফের বড় ভাই শরীফ সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, সন্ধ্যার দিকে মিছিল নিয়ে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী (পরে নির্বাচিত) মাহবুবুল হক লস্করদী বাজারে আসেন। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনিরুল হকের প্রচারকেন্দ্রসহ আশপাশের কয়েকটি দোকানে ভাঙচুর করা হয়। এর কিছুক্ষণ পর সমর্থকদের নিয়ে মনিরুলও ঘটনাস্থলে যান। প্রায় আধা ঘণ্টা পর মাহবুবুল হক জাহাঙ্গীর আলম মাতাব্বর ওরফে কালা জাহাঙ্গীরসহ একদল সমর্থক নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। এতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এর মধ্যেই হঠাৎ গুলির শব্দ শোনা যায়। শরীফ বলেন, গুলির শব্দ শোনার পর তিনি তাঁর ছোট ভাই হানিফের দিকে দৌড় দেন। এ সময় তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়। এতে তাঁর ডান হাতে জখম হয়। তিনি গিয়ে দেখেন হানিফের মাথার পেছনে গুলি লেগেছে। সেখান থেকে রক্ত ঝরছে।
শরীফ বলেন, ‘পুলিশ প্রশাসন আমাগো কোনো সহযোগিতাই করতাছে না, উল্ডা আসামিরা আমাগো আইসা হুমকি-ধমকি দেয়।’ হানিফের মা রেজিয়া খাতুন বলেন, ‘আমার পোলারে মাইর্যা ফালায়া এহন অন্য পোলাগোরে বাড়িছাড়া করছে।’
হানিফ পাঁচ বছরের একটি মেয়ে রেখে গেছেন। তাঁর স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় বাবার বাড়িতে অবস্থান করছেন।
হানিফ খুন হওয়ার ঘটনায় তাঁর আরেক বড় ভাই টিটু মিয়া বাদী হয়ে গজারিয়া থানায় ২৫ মে জাহাঙ্গীর আলম মাতাব্বর ওরফে কালা জাহাঙ্গীরকে প্রধান আসামি করে মামলা করেন। কিন্তু মামলা করার পর থেকে প্রাণভয়ে টিটু পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে কয়েকজন গ্রামবাসী জানান।
হানিফের প্রতিবেশী আরও ১০টি পরিবারের সদস্যরা তাঁদের অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছেন। নূরজাহান নামের একজন প্রতিবেশী বলেন, তাঁর স্বামী আমির হোসেন, দুই ছেলে মোহাম্মদ আলী ও আহাম্মদ আলী সংঘর্ষের ঘটনার দিন থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।’
আত্মগোপনে থাকা আরেক প্রতিবেশী দেলোয়ারের বাবা আইয়ুব খান বলেন, নির্বাচিত চেয়ারম্যানের এক সমর্থক তাঁদের বাড়িতে গিয়ে চাঁদা দাবি করেছেন। টাকা না দিলে তাঁর ছেলেকে গ্রামে আসতে দেবে না বলেও হুমকি দেওয়া হয়েছে। আইয়ুব খান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমগো দোষ আমরা কেন নৌকা মার্কা পছন্দ করি।’
হোসেন্দী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সোহেল বলেন, নিহত হানিফ হোসেন্দী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন।
আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী মনিরুল হক বলেন, ‘আমি কাগজে-কলমে এখনো এলাকার বর্তমান চেয়ারম্যান। এরপরও নিজের জীবনের নিরাপত্তার ভয়ে এখন ঢাকায় আছি। আমার এলাকার জনগণের অবস্থা একবার বোঝেন।’
তবে অভিযোগের বিষয়ে নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক বলেন, ‘আমার লোকদের বিরুদ্ধে হুমকি-ধমকি দেওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, তা ভিত্তিহীন।’
হানিফ হত্যা মামলার প্রধান আসামি জাহাঙ্গীর আলম মাতাব্বরের বাড়ি পাশের ভবানীপুর গ্রামে। ২৪ জুন সেখানে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ২৫ জুন একাধিকবার যোগাযোগ করা চেষ্টা করা হলেও তিনি মুঠোফোন ধরেননি।
অসহযোগিতার অভিযোগ অস্বীকার করে গজারিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হেদায়েতুল ইসলাম ভূঁঞা বলেন, নিহত হানিফ ছাত্রলীগের কেউ নন। সে এলাকার একজন সাধারণ লোক। এ মামলার তদন্ত চলছে।