সাংসদদের হস্তক্ষেপের কাছে স্থানীয় সরকার অসহায়

স্থানীয় সরকারে সাংসদদের হস্তক্ষেপ উন্নয়নে অন্তরায় সৃষ্টি করছে। সরকারের মন্ত্রণালয়ের ১২টি বিভাগ উপজেলা পরিষদের কাছে কাগজে-কলমে হস্তান্তর হলেও বাস্তবে হয়নি। সাংসদদের খবরদারির কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই অনিয়ম থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দরকার ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ।
ইউনিয়ন পরিষদে নারীর ক্ষমতায়ন ও রাজস্ব আহরণ এবং উপজেলা পরিষদের হস্তান্তরিত দপ্তরসমূহের জবাবদিহি শীর্ষক সেমিনারে উপস্থাপিত গবেষণাপত্রে এবং আলোচনায় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এসব কথা বলেছেন। রাজধানীর হোটেল সারিনাতে গতকাল শনিবার এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এই সেমিনারের আয়োজন করে।
উপজেলা পরিষদে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দপ্তর হস্তান্তর এবং স্থানীয় সম্পদের ব্যবহার বিষয়ে গবেষণা করেন মির্জা হাসান, ফারহানা রাজ্জাক, বায়োজিদ হাসান ও আশিকুর রহমান। গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন মির্জা হাসান। তিনি বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে সব সমস্যার জন্মদাত্রী উপজেলা পরিষদে সাংসদদের উপদেষ্টা করে রাখার বিধান। উপদেশ দেওয়ার মাধ্যমে সাংসদেরা সবকিছুতে হস্তক্ষেপ করেন। যে কাজে টাকা যত বেশি, সেখানে উপদেশ বা হস্তক্ষেপ তত বেশি। ইউপি থেকে উপজেলা—সব জায়গাতেই স্থানীয় প্রতিনিধিরা সাংসদের কাছে অসহায়। কৃষিবিষয়ক কাজে অনিয়ম বেশি। তিনি আরও বলেন, এখন স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের দুই জায়গায় জবাবদিহি করতে হয়। তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সতর্কভাবে জবাবদিহি করেন। উপজেলা পরিষদের কাছে করেন দায়সারাভাবে। এটা সুশাসনের অন্তরায়। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে শুধু পরিষদের কাছে জবাবদিহির নিয়ম চালু হলে আইনের শাসন অনেক বেশি জোরালো হতো।
মির্জা হাসান আরও বলেন, উপকারভোগীদের জন্য উপজেলা পরিষদ যে তালিকা তৈরি করে, সাংসদ সাধারণত সেটা নাকচ করে দেন। শেষ পর্যন্ত সাংসদ যে তালিকা তৈরি করে দেন, পরিষদকে বিনা প্রশ্নে সেটি গ্রহণ করতে হয়। ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ টিউবওয়েল সাংসদের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী বিতরণ করতে হয়।
সেমিনারে ইউনিয়ন পরিষদের রাজস্ব আহরণবিষয়ক গবেষণাপত্রটি তৈরি করেন বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক সুলতান হাফিজ রহমান, শাহনেওয়াজ হোসেন ও মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন। তাঁরা শক্তিশালী ইউপি হিসেবে রাজশাহী জেলার হারিয়ান ও মাটিকাটা ইউনিয়ন এবং দুর্বল ইউপি হিসেবে খুলনার বারাকপুর ও দামোদরে কাজ করেন। গবেষণায় তাঁরা ২৮২ জন সাধারণ মানুষ এবং ৪৬ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।
গবেষণাপত্র উপস্থাপন করতে গিয়ে সুলতান হাফিজ বলেন, ইউপির রাজস্ব আদায়ের সামর্থ্য কম। রাজস্ব আদায় হয় ৩ থেকে ৬ শতাংশ। সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে রাজস্ব আদায় কম হয়ে থাকে। নিজেদের ভোট রক্ষা করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিরা রাজস্ব আদায়ে আন্তরিক থাকেন না। গবেষণায় যাঁরা নিয়মিত কর দেন, তাঁদের পুরস্কৃত করার প্রস্তাব করা হয়।
ইউপিতে নারীর প্রতিনিধিত্ব শীর্ষক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন বিআইজিডির গবেষক মাহিন সুলতান, বায়োজিদ হাসান, শাহিদা ইসলাম খন্দকার, আহমেদ আসিফ ইনাম, তৌহিদ ইকরাম মাহমুদ ও সোহেলা নাজনীন। তাঁরা রাজশাহী বিভাগের দুটি উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে কাজ করেন। মাহিন সুলতান বলেন, ইউপির নারী প্রতিনিধিরা সংরক্ষিত পদে নির্বাচন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তাঁদের মতে, সাধারণ পদে নির্বাচন করতে টাকা লাগে এবং রাজনৈতিক শক্তি লাগে। সেটা বেশির ভাগ নারী প্রার্থীর নেই। সে জন্যই তাঁরা সংরক্ষিত নারীর সদস্যপদ বহাল রাখার পক্ষে মত দেন।
মাহিন সুলতান আরও বলেন, বেশির ভাগ নারী প্রতিনিধি সমাজসেবা করতে ইউপির সদস্য হয়েছেন। নির্বাচনের আগে রাজনীতির সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্ততা না থাকলেও নির্বাচনের পর তাঁরা রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। এর মাধ্যমে নারী প্রতিনিধিদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে।
উপজেলা ও ইউপিতে নারীর প্রতিনিধিত্ব-বিষয়ক গবেষণায় সংশ্লিষ্ট উপজেলা ও ইউপির নাম কৌশলগত কারণে উল্লেখ করা হয়নি বলে গবেষকেরা জানান।
তবে সম্পৃক্ত ইউনিয়ন ও উপজেলার সংখ্যা কম হওয়ায় গবেষণাটি কতটা প্রতিনিধিত্বশীল তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সেমিনারের প্রধান অতিথি ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সুলতানা কামাল ও অন্য আলোচকেরা। তা সত্ত্বেও গবেষণায় সব মিলিয়ে যে চিত্র উঠে এসেছে, সেটাই সারা দেশের চিত্র বলে আলোচকেরা মত দেন।
সুলতানা কামাল বলেন, সরকার তৃণমূল থেকে পরিচালিত হবে, এটা সংবিধানের অঙ্গীকার। কিন্তু তৃণমূলের কাজে সাংসদেরা হস্তক্ষেপ করেন, এটি অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। এ সীমাবদ্ধতার মধ্যেও যে সুযোগ আছে, তা কাজে লাগিয়ে তৃণমূলের নেতাদের কাজ করে যেতে হবে। রাজস্ব আদায়ের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। কর দেওয়ার সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক আছে। মানুষ তখন কর দেবেন, যখন তিনি উন্নয়ন দেখবেন। তিনি আরও বলেন, নারী আন্দোলনের ফল হিসেবে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে। তবে এখনো তাঁদের অনেক সমস্যা। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য স্থানীয় সরকারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। সে জন্য দরকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার।
আলোচনায় সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, স্থানীয় রাজনীতিতে নারীরা অনেক এগিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা এখনো বঞ্চিত। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা না পেলে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হবে না। বর্তমানে যে পদ্ধতিতে তাঁদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে, তা ত্রুটিপূর্ণ। সেই পদ্ধতিতে যেতে হবে যাতে নারীর সত্যিকারের ক্ষমতায়ন হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক আখতার হোসেন বলেন, উপজেলায় সাংসদের উপদেশ নির্বাহী আদেশের মতো। তাঁরা এই ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। কাগজে-কলমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ১২টি বিভাগ উপজেলা পরিষদে হস্তান্তর হলেও বাস্তবে কিছুই হয়নি। মূলত সাংসদই সেখানে সর্বেসর্বা, পরিষদের কোনো কর্তৃত্ব নেই।
খুলনার উপজেলার একটি ইউনিয়নের নারী সদস্য নীলিমা চক্রবর্তী বলেন, আগে টিউবওয়েল বিতরণ করতেন চেয়ারম্যান-মেম্বাররা। এখন সেই কাজটি করেন সাংসদেরা। এতে সাংসদের পছন্দের লোকজন টিউবওয়েল পেয়ে থাকেন। আসলেই যাঁদের টিউবওয়েল দরকার, তাঁরা পান না। টিআর-কাবিখাও সাংসদের পরামর্শ অনুযায়ী বিতরণ করা হয়।
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন বিশেষ অতিথি সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত খ্রস্টিয়ান ফচ, সাধারণ আলোচক দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার নাসির উদ্দিন, মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু প্রমুখ।