ড্যাপ বাস্তবায়নেই সমাধান

প্রথম আলো আয়োজিত ‘ধানমন্ডি ও গুলশানে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান?’ শীর্ষক আলোচনায় (বাঁ থেকে) রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা) আবদুর রহমান, অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, মোবাশ্বের হোসেন ও ইকবাল হাবিব l ছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলো আয়োজিত ‘ধানমন্ডি ও গুলশানে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান?’ শীর্ষক আলোচনায় (বাঁ থেকে) রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা) আবদুর রহমান, অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, মোবাশ্বের হোসেন ও ইকবাল হাবিব l ছবি: প্রথম আলো

সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুসারে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা থেকে অননুমোদিত বাণিজ্যিক স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলেছেন, আয়তন ও লোকসংখ্যার অনুপাতে কোন এলাকায় কত সংখ্যক স্কুল, কলেজ কিংবা অন্যান্য স্থাপনা থাকবে, ড্যাপে তার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে। সেই অনুসারে ধানমন্ডি-গুলশানের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষেরই সুবিধা।
গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর কার্যালয়ে আয়োজিত ‘ধানমন্ডি-গুলশানে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান?’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। ড্যাপের আলোকে পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য জনসম্পৃক্ততা ও পেশাজীবীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। সেই সঙ্গে গৃহীত পরিকল্পনা আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে এবং রাজনৈতিকভাবে বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন তাঁরা। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠান স্থানান্তরের জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়ারও পরামর্শ দেন আলোচকেরা।
গতকালের ওই আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস-বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সদস্য (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা) আবদুর রহমান ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব। আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান।
সমস্যার সূত্রপাত: নজরুল ইসলাম বলেন, রাজউক হওয়ার আগে ১৯৫০-এর দশকের শুরুতে বিশুদ্ধ আবাসিক এলাকা হিসেবে ধানমন্ডি এলাকার পরিকল্পনা করা হয়। সে পরিকল্পনা এতটাই বিশুদ্ধ যে বাসিন্দাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু কিনতে হলেও নিউমার্কেটে যেতে হতো। তখনকার দিনে হয়তো তা গ্রহণযোগ্য ছিল। বর্তমান বাস্তবতায় তা সম্ভব নয়।
এদিকে ধানমন্ডির চাইতে বেশি পরিকল্পিত গুলশান এলাকায় দুটি বাণিজ্যিক অঞ্চল রাখা হয়েছিল বলে জানান নজরুল ইসলাম। পরে এই দুটি অঞ্চল ছাড়াও গুলশানের কয়েকটি সড়ককে বাণিজ্যিক ঘোষণা করে রাজউক। এসব সড়কের পাশের আবাসিক প্লটগুলো নির্দিষ্ট ফির বিনিময়ে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা শুরু হয়।

.
.

ইকবাল হাবিব বলেন, ১৯৫০ সালের দিকে প্রতি একরে ৫০ জন মানুষ থাকবে, সে পরিকল্পনা অনুযায়ী ধানমন্ডি এলাকা গড়ে ওঠে। ধানমন্ডিতে এখন প্রতি একরে ৩৮০ জনের বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
সমস্যার বিস্তার: রাজউকের সদস্য আবদুর রহমান বলেন, প্রয়োজনের তাগিদেই আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হয়েছে। ধানমন্ডি এলাকার প্লটগুলোর এক হাজার মালিকের বদলে বর্তমানে হয়েছে ২০-৩০ হাজার। ধানমন্ডির পরিকল্পনায় ছিল দুটি স্কুল, হয়েছে অর্ধশতাধিক।
মোবাশ্বের হোসেন বলেন, আবাসিক প্লটের মালিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান করে একটি অন্যায় করেছেন। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ, পানির বাণিজ্যিক সংযোগ দিয়ে, আয়কর ও রাজস্ব নিয়ে সরকারের অনেক বিভাগ অনিয়মে জড়িয়েছে। সরকারও এসব নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের বড় অংশীদার।
আদালতের রায়: ঘটনার শুরু ২০১২ সালে। ওই সময় একটি রিটের সূত্র ধরে হাইকোর্ট এক রায়ে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা থেকে অননুমোদিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো সরিয়ে নিতে বলেন। তবে আগে থেকেই বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে ঘোষিত ধানমন্ডি ২, ২৭, সাতমসজিদ রোড ও মিরপুর রোড এর আওতামুক্ত ছিল। রায় হওয়ার পর রাজউক ধানমন্ডি থেকে সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেয়। এর বিরুদ্ধে আপিল করে ধানমন্ডির সবচেয়ে বড় ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় ম্যাপল লিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। চলতি মাসের ১ আগস্ট আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে খারিজ হয়ে যায় সেই আপিল। ফলে সব প্রতিষ্ঠানের সরার বিষয়ে নির্দেশ বহাল থাকে।
এ বিষয়ে মোবাশ্বের হোসেন বলেন, রাজউকের আইন ও আইন অমান্য এই দুটি বিষয় ধরেই রায় হয়েছে। আদালতে যদি বাস্তবতাকে সঠিকভাবে তুলে ধরা হতো এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করা হতো, তাহলে রায় বিপরীত হতে পারত।
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘যাঁরা মামলা করেছেন, তাঁরা আবাসিক বলতে কী বোঝাচ্ছেন, তাঁরা কি ১৯৫০-এর দশকের বিশুদ্ধ আবাসিকে ফিরতে চান? যাঁরা মামলা করেছেন, তাঁরা কি বাস্তবতা বোঝেন? আধুনিক নগরায়ণ সম্পর্কে ধারণা রাখেন?’
রাজউক কী উদ্যোগ নিয়েছিল: আশির দশকের শুরু থেকেই ঢাকায় অব্যাহতভাবে মানুষের চাপ বাড়তে থাকে। রাজউক তখন কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়াই একটি নির্দিষ্ট ফির বিনিময়ে বিভিন্ন সড়কে অ-আবাসিক কার্যক্রম শুরুর অনুমতি দিতে শুরু করে।
ইকবাল হাবিব বলেন, ড্যাপে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, আবাসিক এলাকার জনসংখ্যা অনুপাতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্কুল, কলেজ, কমিউনিটি সেন্টারসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হতে পারবে। সরকার ২০১০ সালে এই ড্যাপ অনুমোদন করেছে। তাহলে আবাসিক এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কীভাবে অবৈধ?
এ প্রসঙ্গে রাজউকের সদস্য আবদুর রহমান বলেন, অনুমোদিত ড্যাপের নিয়ম মানছে না রাজউক, এটা ঠিক নয়। তবে যখন আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে, তখন অনেক কিছু দেখা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, আবাসিক এলাকায় আবাসিক ভবনে কেউ অনিয়মের মাধ্যমে হোটেল করেছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয়: নজরুল ইসলাম বলেন, এই পরিস্থিতিতে এসব প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ কিংবা স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় এলাকার মানুষের ওপর এর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিবেচনায় রাখতে হবে। আদালতের রায় কীভাবে মানা হবে এবং জনস্বার্থ কীভাবে রক্ষা করা হবে, এ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ইকবাল হাবিব বলেন, একটি আধুনিক স্মার্ট নগর গড়ার সুযোগ পুরোপুরিই ঢাকার আছে। ঢাকাকে কীভাবে পুনর্গঠন করা যায়, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। এই ঢাকায় থাকা, খাওয়া, বিনোদন, বাজারের ব্যবস্থা—সবকিছুই থাকবে এক এলাকায়।
মোবাশ্বের হোসেন বলেন, প্রায় ৪০ বছরে পুঞ্জীভূত অন্যায়কে এক মুহূর্তে শেষ করে দেওয়া সম্ভব নয়। এর জন্য সময় দিতে হবে। ঢালাওভাবে উচ্ছেদ না করে নগর পরিকল্পনাবিদদের সাহায্য নিতে হবে। আদালতের রায়ে যেসব অননুমোদিত প্রতিষ্ঠানকে সরানোর কথা বলা হয়েছে, ড্যাপ অনুযায়ী সেগুলোকে বৈধ করা সম্ভব।
সমাধানের পথ: বর্তমান সমস্যার সমাধানে আলোচনা সভায় অংশ নেওয়া সবাই একটি বিষয়ে একমত হন, তা হলো অতি শিগগির ড্যাপের বাস্তবায়ন প্রয়োজন। ড্যাপের নির্দেশনা অনুসারে কোন এলাকায় কতগুলো, কী ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থাকতে পারবে, তা নির্ধারণে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। তাঁরা বলেন, আদালতের রায় ধানমন্ডি, গুলশানসহ পুরো ঢাকাকে আধুনিক ও স্মার্ট নগর হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ করে দিয়েছে।
নজরুল ইসলাম বলেন, ড্যাপ অনুসরণ করলে ঢাকাকে একটি সমৃদ্ধ, নিরাপদ ও টেকসই নগর হিসেবে গড়ে তোলা যাবে। ড্যাপকে শুধু বইয়ে বন্দী না রেখে সে অনুযায়ী কাজে নামতে হবে।
রাজউকের সদস্য আবদুর রহমান বলেন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতালগুলোর ক্ষেত্রে রাজউক ড্যাপ অনুসরণ করতে চাচ্ছে। রাজউক আধুনিক স্মার্ট ঢাকা গড়ার পক্ষে। উচ্ছেদ করা বা রাখা সেটা পরিকল্পিতভাবে হলে ভুলভ্রান্তি কম হবে। সবাইকে নিয়ে কীভাবে ড্যাপ অনুসরণ করে এই পরিকল্পনা করা যায়, রাজউক সেভাবে কাজ করবে।