ঢাকার নিদর্শন নিয়ে নগর জাদুঘর

নগর ভবনের চতুর্থ তলায় অবস্থিত ঢাকা নগর জাদুঘর। এই জাদুঘরে পুরান ঢাকার অনেক মূল্যবান জিনিস সংরক্ষণ করা আছে l ছবি: প্রথম আলো
নগর ভবনের চতুর্থ তলায় অবস্থিত ঢাকা নগর জাদুঘর। এই জাদুঘরে পুরান ঢাকার অনেক মূল্যবান জিনিস সংরক্ষণ করা আছে l ছবি: প্রথম আলো

পূর্বে হাটখোলা, পশ্চিমে হাজারীবাগ, উত্তরে রমনা আর দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা। ১৯১২-১৯১৫ সালের ঢাকার মানচিত্রে এটিই মোটাদাগে রাজধানীর সীমানা। পুরোনো মানচিত্রটির পাশেই রাখা আছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এখনকার মানচিত্র। শুধু দক্ষিণ অংশের আয়তনই এখন সে সময়কার পুরো ঢাকার দ্বিগুণের বেশি!
পুরোনো-নতুন মানচিত্র দুটি সংগৃহীত আছে ঢাকা নগর জাদুঘরে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় নগরভবনের ছয়তলায় এর অবস্থান। ১৯৮৭ সালের ২০ জুন পুরান ঢাকার পাঁচ ভাই লেনের একটি বাড়িতে ঢাকা নগর জাদুঘর প্রথম শুরু হয়। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন। অন্য উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন ইতিহাসবিদ সিরাজুল ইসলাম, নগরবিশারদ নজরুল ইসলাম, স্থপতি রবিউল হুসাইন ও শিল্পী হাশেম খান। ১৯৯৬ সালের ২০ জুলাই ঢাকা সিটি করপোরেশনকে জাদুঘরের দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়। ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যের নানা নিদর্শন রয়েছে এই জাদুঘরে।
১০০ বছর আগের ঢাকার এ মানচিত্রটি ছাড়াও এখানে আছে প্রাক্‌-মোগল আমল থেকে বাংলাদেশ আমল পর্যন্ত ঢাকার সীমানার ধারাবাহিক বৃদ্ধির নকশা।
প্রদর্শনীকক্ষের মাঝামাঝি রাখা আছে একটি মুদ্রণযন্ত্র। লোহার এই মুদ্রণযন্ত্রের গায়ে খোদাই করা আছে এর নাম, ‘ইমপ্রুভড আলবিওন প্রেস’। ক্যাপশন থেকে জানা গেল, ১৮২২ সালের এই যন্ত্রটি ঢাকার প্রথমদিককার মুদ্রণযন্ত্রগুলোর একটি। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এটি জাদুঘরকে দান করেছেন।
নবাবি আমলে ঢাকার প্রশাসনব্যবস্থায় মহল্লার পঞ্চায়েতপ্রধান বা সরদারদের বড় ভূমিকা ছিল। মুনতাসীর মামুনের লেখায় পাওয়া যায়, মহল্লার প্রভাবশালী ব্যক্তিই সরদার হতেন। তাঁরা ছিলেন এলাকার অভিভাবক। নগর জাদুঘরে একটি বড় জায়গাজুড়ে আছে এই সরদারদের ছবি আর তাঁদের ব্যবহৃত নানা আসবাব।
জাদুঘরে সংগৃহীত ছবিগুলোও এমন এক ঢাকার গল্প বলে, যার সঙ্গে আজকের ভিড়ভাট্টার যান্ত্রিক নগরের মিল নেই। একটি ছবিতে যেমন দেখা গেল, রমনার পাশে ঢাকা গেটে চরে বেড়াচ্ছে হাতির পাল। শাহবাগে তোলা আরেকটিতে ছবিতে আছে হরিণের দল। ১৯০৪ সালের ঢাকার ছবি এই দুটি।
একটি কাচের শোকেসে প্রায় ২ ফুট দৈর্ঘ্যের চামড়ার মশক রাখা আছে। ষাটের দশকের আগে এসব মশকে করেই হোটেল ও বসতবাড়িতে পানি সরবরাহ করা হতো। যাঁরা বাড়ি বাড়ি পানি পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করতেন তাঁদের বলা হতো ভিস্তিওয়ালা। ষাটের দশকের এক ভিস্তিওয়ালার সাদা-কালো আলোকচিত্রও এখানে আছে।
জাদুঘরে আরও আছে বুড়িগঙ্গাতীরের বিলিয়ার্ড ক্লাব, ঢাকার প্রথম বিদ্যালয় কলেজিয়েট স্কুলের পুরোনো ভবন, ভজহরি সাহা নাটমন্দির, ঢাকার প্রথম পানি শোধনাগারের ছবিসহ বেশ কিছু হারিয়ে যাওয়া স্থাপনার ছবি।
নগর জাদুঘরে গতকাল কথা হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অপু আহমেদের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আজকে পুরান ঢাকার ইতিহাস সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম, যা আগে জানা ছিল না।’
জাদুঘর শুক্র-শনিবার বাদে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোয় সকাল নয়টা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত খোলা। প্রবেশমূল্য ২ টাকা। তবে জাদুঘরে দৈনিক দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশ কম। টিকিট কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা মুক্তা আক্তার বললেন, দিনে ১০-১২টি টিকিট বিক্রি হয়।
ঢাকা নগর জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক ভূপেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বললেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি করতে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে তাদের জাদুঘরে নিয়ে আসতে হবে। তিনি আরও বলেন, জাদুঘরের পরিসর বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে নতুন সংগ্রহ যোগ হতে যাচ্ছে।