হাওরের স্বপ্ন

বাড়িটার সামনে এসে শেষ হয়েছে মেঠোপথ। কিছু দূরেই ধানখেত। ট্রাক্টরের পেষণে মাটি হয়ে আছে ময়দার মতো নরম। বীজ ফেললেই সোনা সোনা ধান। সেই খেতের আল ধরে, মেঠোপথ হেঁটে একটা লালমতো লাজুক বউ হেঁটে আসছে। পেছনে মুখে রুমাল দিয়ে তার চেয়েও লাজুক একটা বর। নয় মাসের আগের স্মৃতিগুলো সুজনের জলে ভেজা ঝাপসা চোখে ফিরে ফিরে আসে।

চারদিকে জল আর জল। বন্যায় ভেসে গেছে হাওর। সেই সঙ্গে মুছে গেছে মাত্রই শিষ আসা ধানখেতের চিহ্ন, সুজনের স্বপ্ন। যেই স্বপ্ন সংক্রমিত করেছিল নতুন বউটাকেও। সারা দিন খেতে খেটে এসে মাথা ঠেলে দিত উষ্ণ, নরম কোলে।

‘বউ, আমি জমিতে কর্ম করি না। আমি কর্ম করি সোনার কারখানায়। আমার জমিতে ধান আসে না, সোনা আসে। এই সোনার মতন ধান আমি তোর পায়ের কাছে আইনা দিমু। দুইজনের সংসারে তুই রানি হয়া থাকবি। আমি তোর রাজা।’

‘দুইজন না, তিনজন।’

‘কী কইলি বউ? আমাগো মেহমান আইতাছে? কবে আইব বউ, তুই কেন কস নাই আগে?’

এরপরের দিনগুলো গেল স্বপ্নের মতো। ধানগাছগুলো বড় হচ্ছে দিন দিন। সুজনের ছোট্ট বউটা দিনে দিনে মোটামতো হচ্ছে, পেটটা ফুলে উঠছে। সেই পেটে জল বাসা বাঁধছে। সেই জলে ক্ষণে ক্ষণে দামাল লাথি। সুজন কান পেতে শোনে অদেখা ভুবনের গান।

একদিন আকাশে মেঘ ঘন করে আসে। কয়েক দিনের মধ্যে বানের পানি ঢোকে হাওরে। প্রতিবেলা একটা করে খারাপ খবর আসে। দুর্বল বাঁধগুলো ভেঙে পড়ছে একটার পর একটা। বন্যার পানি বাড়ছে প্রতি ঘণ্টায়। ফসলের খেত সব ডুবে যাচ্ছে। মাছ মরে ভেসে উঠছে হাওরে হাওরে। মহাপ্লাবনের জল এসে ডুবিয়ে দেয় সুজনের পৃথিবী, স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ।

বউটার পায়ে পানি আসছে। চলতে পারে না। ডাক্তার দেখানো দরকার। টাকা নেই, যাওয়ার উপায়ও নেই। সুজন দেখে এক গ্লাস খাওয়ার পানি, তারও আকাল পড়ে গেছে। টাকা নেই, খাবার নেই, পানি নেই। চাতকের মতো বসে থাকে সুজন, সুজনরা। শহর থেকে মাঝে মাঝে আসে ত্রাণের ট্রলার। ব্যাগভর্তি খাবার, পানি, পোশাক। তারচেয়ে বেশি আসে ক্যমেরার বহর। সুজনরা হামলে পড়ে একেকটা ট্রলারে। মুহূর্তেই শূন্য হয়ে যায় ত্রাণের রসদ। মাঝে মাঝে এক পোটলা চিড়া, কিংবা মুড়ি, অথবা চালও পেয়ে যায় সুজন। দৌড়ে যায় জল-কাদায় মাখামাখি ঘরে। ‘বউ তোর জন্য দুইটা চিড়া আনছি। একটু হাঁ কর পরান।’

বউটার শরীর আরও খারাপ হয়ে গেছে। বন্যার জল কমতে শুরু করেছে। কষ্ট কমার নাম নেই তবু। জীবন থেমে থাকে না। আরও কয়েকটা দিন চলে যায়। পাশের বাড়ির রহিমা দাইয়ের ডাক পড়ে আষাঢ়ের এক রাতে। সারা রাত থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। সুজন উঠোনের মাথায় বসে আছে। মনে একটার পর একটা কুচিন্তা ডাক দিচ্ছে। বউটা মরে যাবে না তো? বাচ্চাটা দুনিয়ার মুখ দেখবে তো? ওকে খাবার দিতে পারবে সুজন? নাকি, খাবারের অভাবে...? নাহ, আর চিন্তা আসে না মাথায়।

হঠাৎ এক তীব্র চিৎকার। পৃথিবীর মাটিতে নবীনতম সন্তান জানিয়ে দেয় তার অস্তিত্ব।

‘সুজন, তোর পোলা হইছে। বউ ভালা আছে।’

বন্যা, অভাব, ক্ষুধাকে পেছনে ফেলে সুজন দৌড়ে যায় ঘরে। একটা নতুন স্বপ্ন বাসা বাঁধতে শুরু করেছে ছোট এই মাটির পৃথিবীটায়।

 লেখক: চিকিৎসক, মাতুয়াইল, ঢাকা