আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে

আবিদ
আবিদ

I am what I am,
Is only because of u……..
Without u I am just zero
To the
Power infinity…. So never
Love me alone…..
Love u so much maa
Happy mothers day.

মা দিবসে কখন যে মেসেজটি এসে মোবাইলে অপেক্ষা করছে, আমি জানি না । গভীর রাতে আমি বাপীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ও সোনা মা, আজ মা-দিবস তুই ভুলে গেলি?’
বাপী তো অবাক—‘বলো ল মা! আমি ভুলে যাব? তোমার জন্য শাড়ি পাঠিয়েছি, বই পাঠিয়েছি, মোবাইলে দুটি প্রাণের কথা পাঠিয়েছি—তুমি পাওনি, না দেখনি?
তাড়াতাড়ি মোবাইলটা অন করলাম, মেসেজটি পড়লাম। আনন্দে আত্মহারা আমি। এই না হলে আমার ছেলে!
কলবেল বেজে উঠল, গিয়ে দেখি এসএ পরিবহন কুরিয়ার সার্ভিস থেকে এসেছে। আপা গতকাল ফেরি চলাচলে অসুবিধা থাকায় এক দিন পর কুরিয়ার হাতে পৌঁছেছে।
আবিদের পাঠানো সুন্দর একটি প্যাকেট ফুল দিয়ে সাজানো। খুলে দেখি শাড়ি, সঙ্গে একটি বই। আহারে আমার মা-দিবস—কোথায় হারিয়ে গেল।
পাশের বাড়ির গাছের পাতাটির ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে একটি তোতা পাখি।

ও তোতা পাখি রে
আমার বাপীকে তুই এনে দে—
ঘুমিয়ে ছিলাম আমি
কখন যে বাপী গেল চলে আমি জানি না রে।

না বলে কখনো কোথাও তো ও যায় না। কিন্তু সবাই বলে ওই আকাশে লুকিয়ে আছে খুঁজে নাও তোমার বাপীকে।
পাখি রে আমার, তুই উড়ে যা আমার বাপীকে নিয়ে আয়। সোনা বাপী আমার। আমি যে আর খুঁজতে পারছি না। কত জায়গায় গিয়েছি। ভোরের আলো ফোটার আগে নিজেই কত খুঁজেছি তোকে। বেলি ফুলের গাছের ফাঁকে, বাড়ির আশপাশে, অলিতে-গলিতে।
আমাকে তুই ভুলে গেলি সোনা বাবা। তোর জন্য কত রান্না করেছি; আমার রান্না ছাড়া তোর কোনো খাবারই ভালো লাগে না। সকালে পুডিংটা যখন সামনে দিতাম, গলাটা জড়িয়ে কেমন করে বলতিস, ‘মাগো, মা আমার, লক্ষ্মী মা, তুমি কী করে বুঝলে আমি এখন পুডিং খাব।’
সবকটা রোজা বরাবরই বাপী রাখত। প্রচণ্ড ধর্মপরায়ণ ছিল। বিশেষ কোনো সমস্যা না হলে নামাজ ক্বাজা করত না। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে আসবে। সেহরিতে কী খাবে, ইফতারি কী করবে সব গুছিয়ে রেখেছি। আমি ওর জন্য আম, দুধ; প্রিয় কই মাছ, ইলিশ মাছ, গলদা চিংড়ি বিভিন্ন ধরনের খাবার গুছিয়ে ডিপ ফ্রিজে রেখে দিয়েছি। বাড়িতে এলেই খাওয়াব। আজও সেই খাবারগুলো ফ্রিজে আছে। শুধু মনে হয়, এই বুঝি এখনই এসে পড়বে। শুধু পথ চেয়ে বসে আছি। আরে হ্যাঁ তো, আসবে তো আমার বাপী সোনা। বিশ্বাস করো তোমরা, ও আসবে আসবেই। আর এই জন্যই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কথায় বলি—
‘আমার এ পথ চাওয়াতেই আনন্দ।’
বিরিয়ানি, চায়নিজ রান্না যখন আমি বাড়িতে শিখে তোকে খাওয়ালাম, উহ তোর সেকি আনন্দ! লক্ষী বাবা, সোনা বাবা, বিশ্বাস কর আমি সব রান্না করে বসে আছি। কখন আসবি কবে ছুটি তোর, আমি তো আর পারি না। বিশ্বাস কর বাবা, আমার বুক থেকে প্রতি রাতে রক্ত ঝরে। আমি পাগলের মতো ছোটাছুটি করি। এঘর-ওঘর। সব দরজা-জানালা খুলে দিই। কখন কোথা থেকে তুই আমাকে দেখে বলবি, ‘মা, তুমি ঘুমাওনি? তোমার যে প্রেশার বেড়ে যাবে। কীভাবে ঘুমাব সোনা . . . ।’ তুই আর বাঁধন দুইজন দুই পাশ থেকে আমার গলাটা জড়িয়ে ধরে ঘুমাতি। আমি সারা রাত নড়তে পারতাম না। তোরা ছাড়া জীবন চলে, বল?
আমি চিন্তা করব বলে তুই বাথরুমে ফোন নিয়ে ঢুকতিস ঢাকার বাসাতে। আমি তো হেসে খুন। তুই দেখে বলতিস, ‘তোমার কারণেই ফোনটা বাথরুমে নিয়ে ঢুকেছি, তুমি চিন্তা করবা আর ঢাকা শহরের সব লোক এক জায়গায় করে দেবা । তুমি যে টেনশন করো। তোমাকে নিয়ে মা আমার খুব ভয় হয়।

আবিদ
আবিদ


তোমাকে যে বাঁচাতে হবে। আমি আর বাঁধন তোমার হাত ধরে অনেক বড় হব। তোমার আশা পূর্ণ করবই করব। মাগো, তুমি শুধু পাশে থেকো।’
এ কোন পাশে থাকা বিধাতা। আমি তোর পাশে থাকি। তবে তোর পাশে বসে ইয়াসিন সুরা পড়ি দুরুদে হাজারি পড়ি। সবাই বলে এগুলো করো, তোমার বাপী আরও ভালো থাকবে। এ কোন জীবন দিলে আমাকে ঈশ্বর ।
মনে আছে তোর, এসএসসি-এইচএসসিম রেজাল্ট নিয়ে বাড়িতে কি আনন্দের বন্যা। প্রথম সন্তানের পরীক্ষা বলে কথা। তারপর দুটোতেই ছিল এ+। মিষ্টি মিষ্টি আর মিষ্টি। সাংবাদিকদের আনাগোনা সাক্ষাত্কার। আমি যেন এক প্রজাপতির মতো উড়তে লাগলাম। তোর বাপীন তো শুনে আনন্দে-আত্মহারা। কোর্টে সবাইকে বলল তোর রেজাল্টের কথা। সবাই বলছিল, মিজান ভাই অভিনন্দন আপনাকে। উত্তরে তোর বাপীন বলেছিল, সবটুকু কৃতিত্ব ওর মায়ের । কথাটি অ্যাড. সেলিম ভাই ফোনে আমাকে জানান, মিজান ভাই তো মা- ছেলে দুজনকে নিয়ে আত্মহারা ।
তারপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোর চান্স পাওয়া। নিয়ে গেলাম পরীক্ষা দিতে। কত ছেলেমেয়ে। দেখে বুকটা একটু কেঁপে উঠল।
মনে মনে ভাবলাম, পারবে তো আমার বাপী? তোর একটাই কথা ছিল, মা, আমাকে পারতেই হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে আমি কোথাও পড়ব না।
ঈশ্বর তোর সহায় হলেন। তুই চান্স পেয়ে গেলি। যেদিন রেজাল্ট বেরোল, সেদিন আমার সেকি কান্না! তোকে জড়িয়ে আমি বলেছিলাম, কী করে থাকব তোকে ছেড়ে বাপী। তুই হেসে বলেছিলি, মা, গতকাল তুমি বলেছিলে আমার ছেলে কোথাও হারেনি, এখানেও হারবে না। ঠিকই চান্স হবে, তুই পড়বি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এখন কাঁদো কেন?
হায়রে বিধাতা, সেই কান্নাই আমার চিরকালের কান্না হয়ে যাবে আমি বুঝিনি বাবা। তুই সত্যিই সত্যিই কখন চলে গেলি। অনার্স, মাস্টার্স দুটোতেই ফার্স্টক্লাস রেজাল্ট করলি। তোর সব রেজাল্ট ফার্স্টক্লাস। তোর চলে যাওয়াও ফার্স্টক্লাস ।
সবাই ভাবে আমি খুব রাগী। আমার রাগটা চোখে পড়ে। অভিমানটা কেউ দেখে না। রাগ আর অভিমান পরস্পরবিরোধী। রাগ ধ্বংস করে আর অভিমান ভালোবাসা দীর্ঘ করে। এই সামান্য পার্থক্য আমি বোঝাতে পারি না। একমাত্র তুই বুঝতি। আমি কোনো ব্যাপারে অভিমান করলে তুই কেমন আমার সারা মুখে চুমু খেতি, জিহ্বা দিয়ে চেটে চেটে কামড়ে কামড়ে খামচে আদর করতিস ।
সবাই বলে নিশুথি রাতে তারার দেশ থেকে তুই নাকি আলো ছড়াতে ছড়াতে আমার কাছে আসিস ।
রোজই ভাবি জেগে থাকি, বাপী কি আমায় দেবে ফাঁকি; কিন্তু ডাক্তার কী ওষুধ দিয়েছে আমি টের পাই না কখন তুই আসিস ।
পাখি আমার লক্ষ্মী পাখি
আমাকে তুই বাপীর কাছে নিয়ে যা

ও যে হাত দিয়ে ভাত খেতে পারে না। আমি মুখে তুলে ভাত খাওয়ায় দিই। আহা রে সোনা আমার, কত দিন পেট ভরে খেতে পারে না। ঢাকা থেকে এলে আমি যখন ওকে হাতে করে ভাত খাওয়াতাম, ও বলত, মা, কত দিন পর পেট ভরে ভাত খেলাম।
আমাকে সাজানো নিয়ে ওর যে কত ব্যস্ততা। শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, স্যান্ডেল, সানগ্লাস, চশমা, ব্যাগ সবই আমার ম্যাচিং চাই-ই। একমাত্র বাপী শাড়ি কিনে পাগলের মতো সারা বসুন্ধরা শপিংমল ঘুরে ঘুরে আমার ম্যাচিং জিনিসগুলো কিনত। কেনা শেষ হলেই ওর কথা ছিল একটাই, ‘বাবারে বা-বা । তোমাকে জুয়েলারিটাও ম্যাচিং দিয়েছি ।
ওর বিয়ে নিয়ে আমার পরিকল্পনা শুনে কেমন হতবাক হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল কাউকে বোলো না, সবাই তোমার প্ল্যানিংটা জেনে যাবে। তুমি সারপ্রাইজ দেবে সবাইকে। সবে তখন ছোট ছোট লাল সবুজ নীল বাতিগুলো নতুন উঠেছে ঢাকাতে। দেখে আমি আর ও দুজনে মিলে প্ল্যানিং করলাম, ঠিক কীভাবে সাজাব ওর বিয়ের আসরটি। এখন সারা জায়গায় ওই রকম লাইট দিয়ে সাজানো হয়। আমি ওই লাইটগুলো দেখতে পারি না, বুকের ভেতর দুমড়েমুচড়ে যায়। কাকে বোঝাব বলো। এই যে বাপী ছাড়া আর কেউ জানে না, বিয়ের গয়না বানিয়েছি। কত যে সুন্দর! কে পরবে? টনিয়া আমেরিকা চলে গেল। বিয়ে করবে না।
ও বলেছিল, মা, তুমি আর আমি মিলে বাড়ি বানাব। শ্বেতপাথর দিয়ে। হ্যাঁ বাবা তোর জায়গাটায়, আমি রাজস্থান থেকে আনা শ্বেতপাথর দিয়ে বানিয়ে দিয়েছি। খুশি তো ? সমরেশ মজুমদারের লেখা উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ পড়ে মাধবীলতাকে ভালোবেসেছিল। ওর মাথার দুপাশেই মাধবীলতাকে দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছি । কত যে ফুল ফোটে থোকা থোকা। শিউলি, বকুল, টগর, অলোকানন্দা, শ্বেতচন্দন আমার আর তোর সবচেয়ে প্রিয় যে ফুল বেলী, সেগুলো দিয়ে তোকে আগলে রেখেছি। অনেকে বলে এটা কি কবরস্থান না আবিদের জন্য তাজমহল!

আবিদ
আবিদ


মনে আছে সোনা বাবা, তুই একদিন রাত ১১টায় কলবেল বাজালি। আমি চমকে উঠে বললাম কে ? ওমা, এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। দরজাটা বন্ধ করে যেই ঘরের দিকে ফিরলাম, তুই বলে উঠলি, মা, আমার মা, লক্ষ্মী আমার মা, দরজা খোলো না। এই যে আমি। আমি চিত্কার করে দৌড়ে যেয়ে তোকে জড়িয়ে ধরেছি। বাঁধন তো তোকে দাদা দাদা করে পাগল করে তুলল। আর তোর বাপীন খুব শান্ত করেই বলল, আব্বু রে সোনা আয় একসঙ্গে খাব। এই মুহুর্তে আমার খাওয়াটা যে কত আনন্দের হবে, দেখবি তোর মা এখনই কত রকম খাবার বানিয়ে ফেলবে। এই তো সারপ্রাইজ। কিন্তু সোনা বাবা, তুই এ কোন সারপ্রাইজ দিলি ? প্রচণ্ড গরম লাগল বললি, আর সঙ্গে সঙ্গে জাপান-বাংলাদেশ ফ্রিজআপ গাড়িতে চড়ে আমার কাছে চলে এলি সারপ্রাইজ দিতে। কেন বাবা, আমার কোথাও কি ভুল হয়েছে! কোন অপরাধে এই শাস্তি।
আমেরিকা, কানাডা গেলি শো করতে। ওমা রাত্রে সেকি কান্না। কী হয়েছে বাবা? বলতেই বলে উঠলি—মা, মনে হচ্ছে, তোমাকে ছেড়ে আমি অনেক দূরে । খুব মন খারাপ লাগছে। আমি বললাম, বোকা ছেলে। এই তো কদিন পর চলে আসবি । সব ঘুরে ঘুরে দেখ। মনে পড়ে, এক মাসে আমেরিকার প্রতিটি স্টেটে শো করলি। আর তোর দাদু বললেন আমাকে, তোর ছেলে এক মাসে পুরো আমেরিকা ঘুরে দেখছে, আমি ১৬ বছরে পারলাম না। সেকি অভিমান। আর আমি ততই হাসি। কত স্বপ্ন দেখেছি তোকে নিয়ে। হায়রে স্বপ্ন। আমি স্বপ্নকে হারিয়ে যেতে দেখেছি। কাছের মানুষকে দূরে সরে যেতে দেখেছি। সবাই বলে ভালোবাসা নাকি হাসতে শেখায়। কিন্তু আমি সেই ভালোবাসাকে গভীর রাতে কাঁদতে দেখেছি। সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন। চারদিক নীরব। আমি আমার ভালোবাসাকে হারিয়ে, নীরবে ভোরের আলোয় ঘুমিয়েছি। আমার এত হাসি, এত ভালোবাসা, এত গান আজ কোথায় গেল?
কষ্ট নামের রং দিয়ে
সুখের ছবি আঁকি
মিথ্যা কিছু আশা দিয়ে
মনকে পূর্ণ রাখি
হাসি নামের অভিনয়ে
কান্নাকে লুকাই
না পাওয়াকে আড়াল করে
স্বপ্নকে সাজাই
জীবনের এই চলার পথে
আমি একা পথিক
দুঃখ কষ্ট সাথি আমার
হয়ে গেছে বর্তমান আর অতীত ।

প্রতিটা অ্যালবামের গান বা কোনো গান ফাইনাল করার আগে আমাকে শোনাত। আমি কানে মোবাইল রেখে ওর গান শুনছি, কিন্তু কাজ করছি আর শুনছি। শেষ হলে বলত, কেমন হয়েছে বলো তো তুমি মা। আমি আসলে পুরো গান ঠিকমতো না শুনেই বলতাম, আরে তোর গান সব সময় ভালো। তোর ওপর আর কেউ গাইতে পারবে নাকি। উফ! তখন যে তুই কি খুশি হতিস। তখনই গান ফাইনাল করে ফেলতিস। পরে আমি হাসতাম আর ভয়ও পেতাম । যদি কোনো জায়গায় ভুল হয়ে যায়। কিন্তু মজার ব্যাপার, কোথাও কোনো ভুল ধরা পড়ত না। আমেরিকা থেকে ফিরেই এয়ারপোর্টে আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে সবার সামনে বুকের মধ্যে মাথাটা রেখে বলত, ওরে শান্তি রে মা। তোমাকে ছেড়ে কোথাও যেয়ে আমি এক দিনও থাকতে পারব না। আমার হাত ধরে গান শুরু করল এয়ারপোর্টের সামনের খোলা জায়গায়।
মা আমার মা
ওগো তুমি যে আমার মা
তুমি যে আমার

মেহেরাবের বাবা, রাজীব, নওরিন, সোনিয়া হেসে তো কুটিকুটি। ওরা বলতে লাগল, আন্টি, সারা প্লেনে আবিদ যে মজা করেছে তা বলে বোঝানো যাবে না। বিউটি তো আমাকে মা বলে ডাকা শুরু করল, ওমনি বিউটির ওপর তেড়ে এসে বলল, আমার মাকে মা বলে ডাকবি না। আমার মা শুধু আমারই মা। বিউটি তখনই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
পায়ে নূপুর পরলে বাপী খুব খুশি হতো। সব সময় একটি কথাই বলত, মা, তোমার পা যেন খালি না থাকে। তুমি সারা ঘরে হাঁটবে আর আমি দূর থেকে হলেও নূপুরের রিনিঝিনি শব্দ শুনব। আমি আজও পায়ে নূপুর পরে সারা ঘরে-বাইরে সব সময় হাঁটি। তুই শুনতে পাস নূপুরের রিনিঝিনি শব্দ? বাবা?

ছোটবেলার আবিদ
ছোটবেলার আবিদ


তপু (সংগীতশিল্পী) টপ ক্যাফেতে তোর অনুষ্ঠানে আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলেছিল, মা, মাগো এবার আমি লিখব তোমার দুপায়ে নূপুর, কোনো পা-ই খালি নয়।
একুশে বইমেলা শুরু হলে বাপীর কী যে আনন্দ। প্রায় প্রতিদিনই বলত তোমার জন্য আজ কী বই কিনব মা? বাঁধনের জন্য মজার মজার বই। আমার জন্য বই । শ্রদ্ধেয় আনিসুল হক, শ্রদ্ধেয় মোহিত কামাল, শ্রদ্ধেয় মো. জাফর ইকবাল, শ্রদ্ধেয়া সেলিনা হোসেনের বই থাকবেই, সেই সঙ্গে অন্য লেখকের বই তো আছেই। একবার শ্রদ্ধেয় মোহিত কামাল তো আমাকে একটা বই উপহার দিলেন ওর হাত দিয়েই ।
২০১১ সালের বইমেলার শেষ বইটি দিয়েছিল মোহিত কামালের চাবি। হায়রে আমার বইমেলা, ফেব্রুয়ারি মাসটা এলে আমি পাগল হয়ে যাই। আমার কিছু ভালো লাগে না। আসলে স্মৃতি হাতড়াতে গেলে দেখি বারো মাসের সব মাসেই সব দিনেই সব ক্ষণেই বাপী আমাকে জড়িয়ে আছে। বাপী তুই যে আমার আঁঁধার ঘরের আলো। তুই আমার আনন্দ ।
জানিস, সোনা মা আমার, আমি আমার আনন্দকে খুঁজে পেয়েছি । সে মাঝে মাঝে দেখা দেয় চিরদিন কেন দেয় না রে ? তোকে যেমন ভালোবাসি, ঠিক তেমনি আমার আনন্দকেও ! কিন্তু তুই আমাকে যতটা বুঝতিস ভালোবাসতিস, আমার অভিমান, আমার কষ্ট আর ভালোবাসা, আনন্দ ততটা বোঝে না। আমার অভিমানকে রাগ মনে করে। যাক, তবুও আমার আনন্দ তো ! তুই কি খুশি হয়েছিস বাবা আমার ?
কত কথা লিখব বল। অনেক কিছু লিখতে গিয়েও লিখতে পারছি না। কলম আর চলছে না। কোনো কিছুর ছন্দ মিলছে না। শব্দের সঙ্গে বাক্যের, সাহিত্যের সঙ্গে রসের কোনো মিল নেই। নেই কোনো শব্দের গাঁথুনি। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, থমকে গেছি আমি, বাস্তবতার সঙ্গে আর লড়তে পারছি না ।
বাঁধন আর আনন্দকে নিয়ে তোকে সামনে রেখে আমি পথ হাঁটছি। দেখি কতদূর যেতে পারি। তার পরও যদি হেরে যাই, তাহলে ঠিক তখনই জীবনের ইতি টেনে দেব। কথা দিলাম সোনা বাবা।
হায়রে যেদিন যাব আমি
পড়বে আমায় মনে
একফোঁটা জল আসতে দিয়ো
তোমার চোখের কোণে
সেদিন যত ডাকো আমায়
দেব না আর সাড়া
তখন আমি হয়ে যাব
আকাশের ছোট্ট একটি তারা ।

হ্যাঁ তো, আমার সোনা লক্ষ্মী বাবা, আর কত দিন একলা থাকব তোকে ছেড়ে। ও তো একদম থাকতে পারে না আমাকে ছেড়ে। ঢাকা থেকে বাসায় ফিরে কী জোরে জোরে মা...মাগো বলে ডাকত। আমি হেসে বলতাম, তুই কি পাগল হলি নাকি? তখন ও বলত গলাটা জড়িয়ে ধরে, মা, কত দিন এমন করে ডাকি না ।
বাস্তবজীবন আর উপন্যাসের জীবন কখনোই এক না। উপন্যাসের শেষ পাতাটি পাল্টানো যায়। কিন্তু বাস্তবজীবনের কষ্টভরা পাতাটি পাল্টানো যায় না সোনা মা আমার। আমি পাতা উল্টাতে চাই।
আচ্ছা সোনা মানিক আমার, তুই বলত সব নদীর স্রোত তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমি যখন নদীর কাছে যাই, তখন তার স্রোত বন্ধ হয়ে যায়। কেন বাবা, আসলে দোষটা কার ? আমার, না প্রকৃতির? বুঝছি না ।
ও হ্যাঁ সোনা আমার, তোর মাধবীলতাকে যেমন বুক দিয়ে আগলে রেখেছি, তেমনি তোর তিনটি সন্তান, ‘এতো ভালোবাসি’, ‘ভালোবাসার প্রহর’, ‘নব আনন্দে জাগো’ তিনজনকে আমি বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াই। ওরা আমার কান্না থামায়, অভিমান বোঝে। আর বলে, এই তো আর কটা দিন পরই তো তুমি তোমার বাপীর কাছে যাবে—তখনই আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই । চিত্কার করে গেয়ে উঠি, ‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে’। আমি আবারও চিত্কার করে গেয়ে উঠি, ‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে’।

লেখক: অধ্যাপিকা রমা রহমান  ( সংগীতশিল্পী আবিদের মা )

সূত্র:  প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের প্রকাশনা তারুণ্যের ৩য় সংখ্যা, প্রকাশকাল ২০১৫।