বেনামি চিঠি

noname
noname

এ নিয়ে পঞ্চমবারের মতো চিঠিটা পড়ছি। পাঠ্যবই এমনকি গল্প-উপন্যাসও একবারের বেশি পড়তে বিরক্ত লাগে। এ চিঠিটার ক্ষেত্রে তেমন হচ্ছে না। হাতে লেখা একটা চিঠির এমন সম্মোহন থাকতে পারে জানা ছিল না। হতে পারে চিঠি লেখার চল প্রায় উঠে গেছে বলেই এর ভেতরের আবেগকে পুরোপুরি ধারণ করতে পারি না। শর্টকাট বার্তা কিংবা সংকেত দিয়ে কাজ চালাতে গিয়ে আবেগকেও সংক্ষিপ্ত আর ভোঁতা করে ফেলেছি।

রুল টানা কাগজে লেখা চিঠিটার শুরু একটু আলাদা। আহা, কী মধুর আবদার! ‘গত সপ্তাহে আমার জানালার পাশের কাঁঠালচাঁপাগাছটা মারা গেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে জানালা খুললেই ফুলের গন্ধে ঘর ভেসে যাচ্ছে না। মনটাই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তুমি তো বলেছিলে আমার মন ভালো করার সব দায়িত্ব তোমার। তাহলে আর দেরি করো না। এই বর্ষাতেই তোমার শোয়ারঘরের ঠিক জানালার পাশে একটা কাঁঠালচাঁপাগাছ লাগাও। তোমার ঘরের পাশে কেন লাগাতে বলছি তা নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই...’

চিঠিটা পড়ার পর থেকে কিছু অদ্ভুত কৌতূহলে সংক্রমিত হয়েছি। অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছেছি এটা কোনো মেয়ের লেখা। সত্যিই কি এটা প্রাপকের কাছে পৌঁছেছিল? এখানে, এই জেলা শহরের সবচেয়ে পুরোনো লাইব্রেরির ধুলোপড়া বইয়ের ভাঁজে কীভাবে এল চিঠিটা? কী ঘটেছিল তারপর? সত্যিই কি পরিণতি পেয়েছিল সে সম্পর্ক? ছেলেটির বাড়িতেও রোজ কি কাঁঠালচাঁপার গন্ধে ঘুম ভাঙত মেয়েটির?

প্রাপকের স্থানে নিজেকে বসিয়ে চিঠিটার জবাব লেখা শুরু করেছি। ‘তোমার চিঠির প্রতিটি অক্ষর ভালোবাসার একেকটি স্মারক। যত পড়ি মুগ্ধতার ঘোরে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। এ মাসের টিউশনির টাকা পেলেই কাঁঠালচাঁপাগাছ কিনে আনব। গাছটা আমি নিজ হাতে লাগাব। আমার লাগানো গাছ আবার বেশি দিন বাঁচে না। তবে দৃঢ়বিশ্বাস, এ গাছটা বাঁচবে। তোমার জন্য হলেও তাতে হলুদ-সাদা ফুল ফুটবে। দখিন হাওয়ায় ভেসে আসা ঘ্রাণে ম-ম করবে এ ঘর। কিছুদিন হলো কাগজ কেটে আমি ফুল বানাচ্ছি। লাল, নীল, বেগুনি ফুল। যেদিন খুব বৃষ্টি হবে, বাড়ির পেছনের ডোবার পানি টলমল করবে, আমরা দুজনে মিলে তাতে কাগজের ফুল ভাসাব। দুটো ফুল পাশাপাশি ভাসতে থাকবে, ঠিক আমাদের মতো...’

অনেকক্ষণ বাদে মুঠোফোন হাতে নিয়েই চমকে উঠি। অর্চি ফেসবুকে অনেকগুলো মেসেজ পাঠিয়েছে। আজ বিকেলে ওর সঙ্গে শপিংয়ে যাওয়ার কথা। সময় বড় অদ্ভুত। এ সময় কাঁঠালচাঁপা আর কাগজের ফুল চেনে না। ঘর সাজাতে হয় প্লাস্টিকের ফুল দিয়ে। হঠাৎ করে উড়ে আসা আবেগ হুট করেই আবার হারিয়ে যায়। চিঠিটা শেষ করেই অর্চিকে ফোন করি। আপ্লুত কণ্ঠে জানাই—

—জানো অর্চি, আমি একটা চিঠি লিখেছি। বেনামি পত্র। ভাবছি কোনো একটা বইয়ের ভাঁজে রেখে দেব। অনেক বছর পরে কেউ হয়তো পড়বে!

—এসব চিন্তা বাদ দাও। আমার মেসেজের উত্তর দেওয়ার সময় থাকে না, সেই তুমি চিঠি লিখবে!

—সত্যি বলছি। তুমি পড়বে চিঠিটা?

—ছবি তুলে পাঠাও। সময় পেলে পড়ে দেখব। দয়া করে এখন বের হও।

ছবি তুলে পাঠানোর জন্য এ চিঠি আমি লিখিনি। অর্চিকে সে কথা বলে লাভ নেই। চিঠিকেন্দ্রিক ভালো লাগাগুলো ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। সময় কত কিছুই বদলে দেয়, তা-ও নিষ্ঠুরভাবে। একসময়ের ‘কীভাবে পাঠাব’ চিন্তাটা এখন ‘কাকে পাঠাব’তে এসে ঠেকেছে।