গেঁথে আছে বুকের ভেতর

আমাদের গ্রামে এখন দুটি শহীদ মিনার আছে। একটা শোভাগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে, যেখানে পড়াশোনা করেছি আমি। আরেকটা আমাদের ইউনিয়ন পরিষদ ভবন চত্বরে।
দুটি শহীদ মিনার নির্মাণের সঙ্গেই প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার সৌভাগ্যও হয়েছে আমার। সে এক অন্য রকমের অভিজ্ঞতা। ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ মানেই বাবার ভোরবেলা ডেকে তোলা।
তারপর সাত ভাইবোনকে বাড়ি থেকে বের করে দিতেন তিনি। বের হওয়ার আগে সবার পায়ের স্যান্ডেলগুলো খুলে নিয়ে রাখতেন। আমরা সাত ভাইবোন ভোরবেলা পৌঁছাতাম স্কুলের মাঠে, সেখানে অপেক্ষায় কোকিল দাদা, নূপুর দাদা, খোকন ভাই, লিখনসহ আরও অনেকে। খবির স্যার, জলিল স্যার আর নেপাল স্যারও চলে আসতেন সেই সময়েই। স্কুলের বাকি সব শিক্ষার্থীর আসার সময় সকাল ৭টা। এর আগেই আমাদের তৈরি করতে হতো শহীদ মিনার। কেননা, পুরো গ্রাম কিংবা আশপাশের গ্রামগুলোতেও তখনো কোনো শহীদ মিনার নির্মিত হয়নি। আর তাই আমাদের নির্মাণ করতে হতো অস্থায়ী শহীদ মিনার। আর সেটা তৈরি হতো কলাগাছ দিয়ে। আগের রাতেই দুই রকমের কলাগাছ কেটে রাখতেন জব্বার চাচা। একটি খুব বড় আর দুটি তার থেকে একটু ছোট। সেই তিনটি আবার কেটে সাইজ করতাম আমরা।
স্বাস্থ্য ভালো হওয়ায় রেজা ভাইয়ের ওপর দায়িত্ব পড়ত মাটি কেটে গাছগুলো দাঁড় করানোর। সেটাকে নানা রকম রঙিন কাগজে মোড়াতে ব্যস্ত থাকতাম অন্যরা। আমাদের সঙ্গে যে কজন মেয়ে সদস্য থাকত, বিশেষ করে রিতা আপা, তাঁর নেতৃত্বে গাথা হতো নানান রকম ফুলের মালা। কোনো কোনোবার ডালাও তৈরি করতেন তিনি। ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে ঠিক ৭টার আগেই শেষ হয়ে যেত আমাদের কলাগাছের শহীদ মিনার। ৭টা থেকে শুরু হতো আমাদের স্কুলসহ বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের লাইন করে শ্রদ্ধা নিবেদন।
অদ্ভুত একটা শিহরণ বইত তখন শরীরে। কখনো ছোট আপাকে জড়িয়ে ধরতাম। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে পারার যে ভালো লাগা তখন কাজ করত, তার তুলনা হয় না। আর সেই ভালো লাগার জায়গা থেকেই শুরু করেছিলাম শহীদ মিনার নির্মাণের আন্দোলন। এখন গ্রামে দুটি শহীদ মিনার। তবে সেই মিনারে আমার আর শ্রদ্ধা নিবেদন করার সুযোগ হয় না। বুকের ভেতর গেঁথে আছে কলাগাছের শহীদ মিনারের সেই স্মৃতি, যা মনে হলে আজও ভালো লাগায় শিহরিত হয় শরীর।

লেখক: সাবেক সভাপতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা