প্রতিবেশী

উঁচু পাঁচিলটা মাথায় ভাঙা কাচ বসানো। টপকাতে গেলে কষ্ট করতে হবে অনেক। রাত বাজে এগারোটা। বুড়ো লোকটা ঘুমিয়ে পড়েছেন, নাকি জেগে আছেন এখনো? তাঁর রাত জাগার রোগ আছে, জানাল রবিন। ঠিক উল্টো পাশেই ওদের বাসাটা কিনা।

লোকটা নাকি শহরের কোর্টের বিচারক ছিলেন। ছেলেরা সব বিদেশ থাকে। বুড়োবুড়ি দুজন ছোট্ট বাসাটাতে দিব্যি ছিলেন। একতলা বাসা, সামনে ফুলের বাগান, চারদিকে উঁচু পাঁচিল। মাস দুয়েক আগে স্ত্রী ওপারে চলে গিয়ে একা করে দিল লোকটাকে। দিনরাত কীভাবে কাটে ভেবে পাই না আমরা। কখনো কথা হয়নি যে!
আজ ফেব্রুয়ারির বিশ তারিখ। বারোটার পরে নতুন একটা দিন, আরেকটা একুশে ফেব্রুয়ারি, আরেকটা শোকের দিন, শোক থেকে শক্তি সঞ্চয়ের দিন। আরেকটা মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার দিন। যে ভাইয়েরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে একটা অধিকার এনে দিল, মাকে মা বলে ডাকার অধিকার, ভাইকে ভাই বলে ডাকার অধিকার, তাঁদের সম্মান জানানোর দিন। সবাই ফুল নিয়ে যাবে শহীদ মিনারে। হাইস্কুলের ছাত্ররা যাবে, কলেজের ছেলেরা যাবে, কলোনির কাকুরা যাবে, যে লোকটা কিছুই করে না, সেও যাবে। শ্রদ্ধা জানাতে চাই একটা আর্দ্র মন, হৃদয় ভরা ভালোবাসা। আর কিছু ফুলের স্তবক। আমরা সদ্য প্রাথমিক শেষ করা কয়েকজন বন্ধু। এত কিছু কি আর বুঝি! হলুদ হলুদ গাদা আর কয়েকটা রজনীগন্ধা দিয়ে বানিয়ে ফেললাম একটা তোড়া।
‘গোলাপ দিতে হবে, লাল গোলাপ, ঠিক মাঝখানটায়।’ সুমনের আবদারে সায় দিল রবিন, ‘বুড়োর বাগানে লাল গোলাপ আছে। আজ সকালেও দেখেছি। কিন্তু আনতে গেলে দেয়াল টপকাতে হবে। বিচারকের বাসায় চুরি, ধরা পড়লে সোজা হাজতবাস।’ আমাদের মাথায় ততক্ষণে ভর করেছে ‘বিপ্লবের’ ভূত। একুশের বাতাস খুব ভয়ংকর। মই বেয়ে আমরা চলে এলাম বাগানে। কিন্তু ফুল তো নেই একটাও! কে নিল সব ফুল?
কাঁধে একটা শক্ত হাতের স্পর্শে চমকে উঠলাম। হাতে একগোছা গোলাপ নিয়ে লোকটা দাঁড়িয়ে আছেন। অবাক হয়ে দেখলাম, লোকটা হাসতে জানে। মোটা চশমার পেছনে পাথর নয়, মানুষের চোখ। সে চোখ দুটো ভেজা ভেজা। ‘দাদু ভাই, তোমরা ফুল নিতে এসেছ? এই নাও গোলাপ। আর আমাকে নাও তোমাদের সঙ্গে, নেবে না? একুশের প্রথম প্রহর এল বলে।’
‘আনিস ভাইকে আমি বলতাম আনুদা। সে বছরই ভর্তি হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর আমার হয়তো তোমাদের মতোই বয়স। প্রতি শনিবার আনুদা বাসায় আসত। আমার জন্য একটা পেনসিল কিংবা একটা বই থাকত হয়তো। শেষবার এনেছিলেন একটা পোস্টার, “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”। আমি আর কী বুঝি এসবের। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, একুশ তারিখ। আমরা জানি ভাইয়া আসবে দুই দিন পর। সন্ধ্যায় শুনি ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে আছে আনুদাও।’
কণ্ঠ ধরে আসে লোকটার। চোখ ভিজে যায় আমাদের। আমরা ঘরে ঢুকি। দেখি দেয়ালে এখনো লাগানো আছে সেই পোস্টার, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। দূরে কোথাও ভেসে আসে সুর, আমি কি ভুলিতে পারি।
না, আনুদাকে ভুলিনি আমরা। ভোলা যায় না কোনো দিন। একুশের প্রথম প্রহরে তাই আমরা বারবার ফিরে যাই বাহান্নতে।

লেখক: বন্ধুসভার সদস্য, চিকিৎসক