রফিক মাথা তুলতে চায়

অলঙ্করণ: মাসুক হেলাল
অলঙ্করণ: মাসুক হেলাল

সকালের রোদ একটু একটু করে চোখে পড়ছে রফিকের। অনেক কষ্টে চোখটা খোলে সে। পৌষের সকাল, বেলা বুঝতে কষ্ট অনেক। এমনিতেই কয়েক দিন ধরে কুয়াশা পড়ছে খুব। তার ওপর রাতের সেই অত্যাচার। লাঠির বাড়ি, ঘুষি, চড়, লাথি—ভাবতেই বুকটা কেঁপে ওঠে। চোখ আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে আসে রফিকের।

তবে মাথাটা কাজ করছে ঠিকমতোই। সব মনে পড়ছে এক এক করে। সুমিদের বাড়ির পেছনে সরিষাখেত। হলুদ পাকা ফুলে আগুন ধরেছে। সেই খেতে রফিক লুকিয়ে ছিল রাত ১১টার দিকে। কথা ছিল, মুঠোফোনে কল দিলেই পালিয়ে আসবে সুমি। কল দিয়েছিল সে। কিন্তু সুমির বদলে লাঠি, রামদা নিয়ে ছুটে এল আট-দশটা ছেলে।

রফিক চোখ খোলে, দাঁড়ায়। গ্রামের শেষ মাথায় নদীর ধারে ফেলে রেখেছিল ওকে। মাথাটায় চিনচিন করে একটা ব্যথা হচ্ছে। কপালে হাত দিয়ে দেখে জমাট রক্ত। হাত-পা জায়গায় জায়গায় কালচে নীল, ফুলে আছে। হাড় কয়টা ভেঙেছে কে জানে। তবে অবাক ব্যাপার হচ্ছে, গ্রামের পৌষের সকাল কিন্তু শীত করছে না মোটেই। অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। এর চেয়ে অবাক ব্যাপার, রফিক হাঁটতে পারছে একটু একটু করে। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত জিনিস হচ্ছে মস্তিষ্ক এখনো শুধু সুমির কথাই ভাবছে। মেয়েটা কি তার বিশ্বাসের সঙ্গে প্রতারণা করেছে? নাকি বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছে নির্মম বাস্তবতা? সুমি কি জানে রফিকের এ অবস্থার কথা? নাকি এক রাতেই প্রেমিকের কথা ভুলে গেছে বিয়েবাড়ির বউটা।

হ্যাঁ, আজকেই বিয়ে হওয়ার কথা সুমির। গ্রামের প্রচণ্ড প্রতাপশালী চেয়ারম্যানের মেয়ে আর স্কুলের প্রধান শিক্ষকের একমাত্র ছেলেটা যখন পাঁচ বছর গোপন প্রেম করে একসময় বুঝতে পারে কেউ মেনে নিচ্ছে না এই সম্পর্ক, তারা তখন অবাক আবিষ্কার করে একজনকে ছাড়া বাঁচবে না আরেকজন। একদিন ঠিক করে যে তারা পালিয়ে যাবে। সেটাও বিয়ের ঠিক আগের রাতেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিটা এখনো পেরোতে পারেনি ছেলেটা। চেয়ারম্যানবাড়ির মেয়েদের পড়ালেখা টেনেটুনে এসএসসি। এক সুমিই স্কুল শেষ করে পা রেখেছে কলেজে। শীতটা শেষ হলেই এইচএসসি পরীক্ষা। অথচ একদিন হঠাৎ চেয়ারম্যান এসে বলে, ‘সুমির মা, তোমার মাইয়ার বিয়া ঠিক কইরা আইলাম। অনেক বড় সম্বন্ধ। এমপি সাবের শালা দাম্মাম থেইকা ফেরত আইছে। এই শীতেই বউ ঘরে তুলতে চায়। আমারে প্রস্তাব দিল এমপি সাব, ভাবতে পারো? এমপি সাব নিজে প্রস্তাব দিছে, বাপ রে বাপ! আলহামদুলিল্লাহ কও। সুমি, একটু এদিক শোনো তো মা।’

তবে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক কঠিন। ওরা ওদের পরিবারে পর্যন্ত বলেনি কিছু। বলতে পারেনি। হয়তো বলা যেত। কিন্তু অনেক ‘যদি’ ওদের পথ আটকে দেয়। সবুজ সুমির ছোট ভাই। এই মাত্র কয়েক দিন আগে নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় হাতেনাতে ধরা পড়ে নকলসহ। ‘যদি’ প্রধান শিক্ষক তাকে কান ধরে বের না করে দিতেন, ‘যদি’ তিনি চেয়ারম্যান সাহেবের সম্মানের কথা মাথায় রাখতেন। অথবা ‘যদি’ চেয়ারম্যান নিজে প্রধান শিক্ষককে সবার সামনে অপমান না করতেন, ‘যদি’ কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে গলায় ধাক্কা না দিতেন। এই দুই পরিবারের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বৈপরীত্য কিছুই হয়তো বাধা হতো না, কিন্তু ‘যদি’গুলো খুব বিশ্রীভাবে চোখ রাঙাচ্ছিল। চেয়ারম্যানের কিছু দুর্নীতির কথা ইদানীং লেখা হচ্ছিল পত্রিকায়। ফেঁসে গেছেন তিনি ভালোভাবেই। এখন এমপি সাহেব শেষ ভরসা। চল্লিশের কাছাকাছি বয়সী শ্যালক একটা খুনের মামলায় এক যুগ ধরে বিদেশে পালিয়ে আছে। দুজন মিলে তাই দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর হিসাব কষতে বসেন। বেচারা সুমি। রফিকের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না তার।

সবকিছু ঠিকমতো গুছিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সুমি সন্ধ্যা থেকে মনমরা হয়ে থাকবে। বিয়ের আগের রাতটা থাকবে প্রিয় দাদির সঙ্গে। দাদির ঘরটা বাড়ির একেবারে শেষ মাথায়। কেউ আসে না এই ঘরে। ঘরটা থেকে পেছনে গেলেই সরিষাখেত। গ্রামে পৌষে ছয়টা বাজতেই রাত নেমে যায়। ১১টা মানে মাঝরাত। সাড়ে ১০টায়ও সুমি মেসেজ পাঠিয়েছে, সব ঠিক আছে। তারপরেও কী করে এমন হলো, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না রফিক। উত্তরটা জানা খুব দরকার। এই উত্তর না জানলে একটা জীবন বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে যাবে সব হারানো ছেলেটার।

খুব ধীর পায়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সরিষাখেতে আসে রফিক। ফোন রাতেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে বিয়েবাড়ির শামিয়ানা। লোকজনের ভিড়। বরযাত্রী এসে গেছে হয়তো তাই এত লোক, ভাবে রফিক। দুঃসাহস কিংবা পাগলামি থেকেই হয়তো রফিক আরেকটু এগিয়ে যায়। ঠিক তখনই কেউ একজন দেখে ফেলে ওকে।

‘ওই হারামজাদা আবার আইছে। ধইরা বাঁধ শয়তানটারে।’

কিছু বলার আগেই আবার রফিকের গায়ে চড়থাপ্পড় পড়তে থাকে। ওকে টেনে নিয়ে আসা হয় চেয়ারম্যান বাড়ির উঠোনে। রাতের না শুকানো ঘাগুলো আবার জেগে ওঠে। দুর্বল শিরাগুলো টগবগ করতে থাকে। বিধ্বস্ত রফিক অনেক কষ্টে মাথা তুলতে চায়। আর তাকিয়েই চমকে ওঠে। উঠোনে কফিন, একটা লাশ ঢেকে রাখা হয়েছে। পৌষালি লোবানের গন্ধে রফিকের মাথা ঘুরতে থাকে। চেয়ারম্যান শুধু একবার গর্জন করে ওঠে, ‘এই হারামিটার লেইগা আমার মাইয়া গলায় ফাঁস দিছে। রামদাটা বাইর কর। আমি নিজে ওরে জবাই দিমু।’