ব্যর্থতার পরে সফলতা

অংকরণ: মাসুক হেলাল
অংকরণ: মাসুক হেলাল

উচ্চশিক্ষাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দেওয়ার কৌশল শিখিয়ে থাকে। কেনই বা শেখাবে না, শুধু ব্যবসায় উদ্যোগী হতে চাইলেই যে নেতৃত্বদানের শক্তি থাকতে হয় তা নয়, বরং ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য আবেদন করতে গেলেও নেতৃত্বদানের দক্ষতা লাগে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের নানা সমস্যা সমাধান ও যেকোনো নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করতে গেলে নেতৃত্ব দেওয়ার দক্ষতা উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। তাই বলা যেতে পারে, প্রত্যেক অনুসরণকারীকেও একজন নেতা হয়ে উঠতে হবে।

অনেক শিক্ষা খাতা–কলমে দেওয়া গেলেও নেতৃত্বদানের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে হাতে-কলমে। আমরা নেতা হয়ে ওঠার আগে সফল নেতাদের গল্প পড়ি আর তাঁদের অনুসরণ করার চেষ্টা করি কিন্তু সেই সফল নেতাদের ব্যর্থতার গল্পগুলো থেকে যায় অজানা। সফল নেতাদের সফলতা পড়তে পড়তে স্বপ্ন দেখি আকাশসমান আর নিজেকে নিয়ে কল্পনা করি একজন ভবিষ্যৎ সফল নেতা হিসেবে। পা বাড়িয়ে দেয় সফল হওয়ার পথে। এক পা বাড়িয়েই দেখি, ওমা! আমি তো ব্যর্থ হলাম! লজ্জায় দ্বিতীয় চেষ্টা করতে হিমশিম খাই। এ প্রসঙ্গে কামিনী রায় যথাযথভাবে ভেবে বলেছিলেন,

‘করিতে পারি না কাজ, সদা ভয়, সদা লাজ,

সংশয়ে সংকল্প সদা টলে,

পাছে লোকে কিছু বলে।’

যদি লোকে কিছু বলে! এই লজ্জা আমাদের বাধা দেয়। ভয় পাই ব্যর্থতাকে। আটকে রাখে নতুন কিছু করা থেকে।

একটু খতিয়ে দেখলে ঠিক বুঝতে পারবেন, প্রতিটি সফল নেতা জীবনে যতবার জয়লাভ করেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশিবার ব্যর্থ হয়েছেন। বেস্ট সেলার বই বেগুনি গরু–এর (পার্পল কাউ) লেখক সেথ গডিনের একটি উক্তি মনে পড়ে যায়, ‘সে–ই সবচেয়ে বেশি সফলতা অর্জন করেছে, যে বেশিবার ব্যর্থ হয়েছে।’ সুতরাং সফল নেতা বলে যাঁদের আমরা চিনি, তাঁরা সবাই কিন্তু ব্যর্থ নেতাও বটে।

তাই তো...কেথি রোজ তাঁর পারফরম্যান্স ব্রেকথ্রু বইতে খুব ভালো করে বর্ণনা করেছেন আমাদের প্রত্যেকের জীবনের সেই ব্যর্থতাগুলো, যেগুলো না থাকলে আমরা হয়তো কোনো দিন কথা বলতে পারতাম না, হাঁটতে শিখতাম না, এমনকি ভাবতেও শুরু করতাম না। ভেবেছেন কখনো, কতবার ব্যর্থ চেষ্টার পর, ঝুঁকি নিয়ে আমি-আপনি সেই ছোটকালে হাঁটতে শিখেছি! আমি হলফ করে বলতে পারি, তখন যদি আমাদের এই বোধ থাকত যে ঝুঁকি নিচ্ছি, প্রথম চেষ্টায় তো কখনোই না বরং শতবারের বেশি চেষ্টা করতে হবে হাঁটতে শিখতে হলে, তাহলে প্রথম পদক্ষেপ কেউ দিতাম না। অনুসন্ধান বলছে, ৯৮ শতাংশের বেশি মানুষ হাঁটতে শিখত না শুধু হেরে যাওয়ার ভয়ে।

আমাদের অনেকের ধারণা, প্রথম চেষ্টাতেই সফল হওয়া চাই। একবার ব্যর্থ হলে নিজের যোগ্যতা নিয়ে প্রথম প্রশ্ন তুলি আমরা নিজেরাই। বন্ধুরা, একবার যদি হেরে যেতে শুরু করেন, ব্যর্থতার সংখ্যা বাড়াতে পারেন, তখনই বুঝবেন সফলতার কাছাকাছি আপনি এখন। ঠিক যেমন আমাদের ছোটকালে আপনি-আমি ভাষাশূন্য ছিলাম, আর হাজারখানেক ভুলভাল অর্থহীন আওয়াজ দিয়ে ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলাম মাকে মা বলে ডাকতে, আর ঠিক তার পরেই প্রথম মা বলে ডেকে জানিয়ে দিয়েছিলাম প্রিয় এই পৃথিবীকে যে ‘আমি পারি’! আমরা সবাই শুরু করেছিলাম ব্যর্থতা দিয়ে, আর এরপর এক এক করে একগাদা ব্যর্থতার বদলে সফলভাবে হাঁটতে শিখেছি, মাকে মা বলে ডাকতে পেরেছি। আমার মনে হয়, এটা সম্ভব হয়েছিল কারণ নির্লজ্জের মতো আমরা ব্যর্থ হয়েছি আর ফের বারবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছি।

সুতরাং বলেন! ব্যর্থতার ওপর কেন মাস্টার্স করবেন না? এটা তো স্পষ্ট যে সফলতার আগে ব্যর্থতা আর ব্যর্থতার পরে সফলতা। প্রখ্যাত চিত্রকর পাবলো পিকাসোও বললেন, ‘আমি সেটাই বেশি বেশি করি, যেটা আমি পারি না, তাতে আমি নতুন কিছু শিখতে পারি।’ স্বপ্ন অর্জনে যখন বান্ধন-ছান্দন দিয়ে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি, নতুন কিছু করি, ঠিক তখন যদি ভুলে যাই ব্যর্থ হওয়ার কথা, তাহলে কিন্তু সফলতা আরও বেশি বিলম্বিত হবে।

চলো বন্ধুরা, সফল নেতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হই আর স্টিভ জবসের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি, আরেকটু ক্ষুধার্ত হই, আরেকটু বোকা হই।

লেখক: শিক্ষক, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক, প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ।