আবছা আলোয় ফুটে ওঠে

অনুভূতিতে বড্ড নাড়া দেয়। কেমন ছিলেন বাবা! স্মৃতি হাতড়ে চলি। আবছা আলোয় ফুটে ওঠে বাবার দৃঢ় সাহসী মুখাবয়ব। মিলিটারি যখন ধরে নিয়ে যাচ্ছিল বাবাকে, সেই কথা। আমি খুব ছোট্ট তখন। আমাদের পুরো পরিবার পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী।

১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল দিনটি। আগের রাতে ভয়াবহ যুদ্ধ হলো সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে। নিরস্ত্র বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে অসম তুমুল যুদ্ধ পাকিস্তানি আর্মির। আমাদের বাড়িটি ছিল মাঝে। এর দক্ষিণে বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর উত্তরে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সেনানিবাস। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তৎকালীন রেলওয়ের হিসাব কর্মকর্তা বাবা মো. আয়েজউদ্দিন আমাদের বাড়িতে উড়িয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল-সবুজের পতাকা। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ উজ্জীবিত করছিল হয়তো স্বাধীনচেতা বাবাকে। তিনি পাকিস্তানিদের সঙ্গে সব রকম অসহযোগিতা শুরু করে দেন। প্রতিবেশী ডা. এম এ আজিজ চাচাকে নিয়ে তিনি অবাঙালি (বিহারি) অধ্যুষিত বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করতে থাকেন।

তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে—বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে আন্দোলিত হন বাবা। তিনি বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের সহযোগিতায় আমাদের বাড়ির উঠানে খুঁড়ে ফেলেন সামরিক পরিখা (বাঙ্কার)। এর মাঝে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অ্যাকশন প্রতিহত করা যাবে। বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের কয়েকজন বাবার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন। সারা রাত প্রতিরোধ যুদ্ধ হলো। আমাদের বাড়ির আশপাশে পড়ে থাকতে দেখা গেল বাঙালি সৈনিকের অসংখ্য লাশ। আমরাও বন্দী হলাম। এরপর বোমার আঘাতে আমাদের বাড়িটি উড়িয়ে দেওয়া হলো।

পাকিস্তানি আর্মিরা যখন বাবাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন বাবা শুধু একটা কথাই বলেছিলেন। আমি হয়তো ফিরে আসব না, কিন্তু দেশ স্বাধীন হবেই। ওদের জুলুম বেশি দিন চলবে না। বাবাকে সৈয়দপুর সেনানিবাসের কোয়ার্টার গার্ডে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। কিন্ত মোটেও টলাতে পারেনি তাঁকে। একই সঙ্গে সৈয়দপুরের সাংসদ ডা. জিকরুল হক (শহীদ বুদ্ধিজীবী), আওয়ামী লীগ নেতা ডা. বদিউজ্জামান, ডা. সামসুল হক, ন্যাপ নেতা ডা. এস এম ইয়াকুব, ব্যবসায়ী নেতা তুলসীরাম আগরওয়ালা, রামেশ্বরলাল আগরওয়ালা, যমুনা প্রসাদ কেডিয়া প্রমুখ বন্দী ছিলেন। তাঁদের সবাইকে ১২ এপ্রিল রংপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার নিসবেতগঞ্জে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
বাবার লাশ আজও খুঁজছি আমি। পাইনি তাঁর মরদেহের সন্ধান। তবে পেয়েছি বাংলাদেশ।

সৈয়দপুর (নীলফামারী) প্রতিনিধি