নূর হোসেনের মিছিল

কার্তিকের রাত শেষ করে নির্ঘুম সূর্যোদয়।
চত্বর থেকে ডেকে উঠল যুগল দোয়েল,
ঢাকা শহরের সমস্ত কাক সমস্বরে
ডেকে উঠল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ থেকে,
সাইরেন বাজল কমলাপুর স্টেশনে;
পতাকা হাতে দশ দিক থেকে ছুটে আসছে মানুষ
গণতন্ত্রের মিছিলে—
বুকে-পিঠে ব্যানার নিয়ে হাজির হলেন নূর হোসেন!
২৬ বছরের তাগড়া যুবক
কালের নায়ক
সবাই সমবেত হন মিছিলে।
গ্রাম থেকে, আদমজীর মিল থেকে,
ডেমরা-পোস্তগোলা-কামরাঙ্গীরচর,
সাভার-গাজীপুর আর নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে
ছুটে আসা জনতা সব যোগ দিল মিছিলে
বিশ্ববেহায়ার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাতে।
সমবেত সবার
মুষ্টিবদ্ধ হাত হাতুড়ি হয়ে আঘাতে আঘাত ছুড়ল
দামামার বুকে,
সম্মিলিত কণ্ঠ নির্গত কবিতার বজ্রনিনাদ:
স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক
ধ্বনিতে ধ্বনিতে প্রকম্পিত
বায়তুল মোকাররম মসজিদের সুদৃঢ় প্রাচীর,
হাইকোর্টের সফেদ গম্বুজ, তোপখানা-পুরানা পল্টনের
হোটেল-রেস্তোরাঁ, বিপণিবিতান কেঁপে উঠল, আর
কেঁপে উঠল কাঁস্তে-হাতুড়ির পতাকা ওড়ানো
লাল দালান—
নড়াইলের ধানখেত থেকে সুলতানের পেশিবহুল 
কৃষকেরা এলেন দল বেঁধে,
হাজং-সাঁওতাল আর নানকার বিদ্রোহীরা এলেন
দামামা বাজিয়ে—
বিদ্রোহের সিপাহিরা কুচকাওয়াজ করতে-করতে 
এলেন বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে,
জয়নুলের ক্যানভাসের দড়ি ছিঁড়ে বিদ্রোহী তেজি ষাঁড়টা
ব্রহ্মপুত্রের বালুচর থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে
হাট-মাঠ-রাজপথ পেরিয়ে রাজধানীর
জিরো পয়েন্টে এসে যোগ দিল নূর হোসেনের মিছিলে।
নূর হোসেন! নূর হোসেন!
বুকে-পিঠে উঁচিয়ে ধরা সাহসী ব্যানার
স্বৈরাচার নিপাত যাক 
গণতন্ত্র মুক্তি পাক
জেলখানার দেয়ালে রক্ত দিয়ে ‘বিপ্লব’লেখা ব্রেখটেরই
পথমঞ্চায়ন হবে আজ ঢাকার রাজপথে—
রংপুর থেকে এলেন নুরলদীন, নারকেল বাড়িয়ার 
বাঁশেরকেল্লা থেকে এলেন তিতুমীর,
মহাস্থান গড় থেকে ফকীর মজনু শাহ,
চট্টগ্রাম থেকে সূর্য সেন-প্রীতিলতা,
বায়ান্ন থেকে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার আর
টুঙ্গিপাড়া থেকে ধোপ-দুরস্ত পাঞ্জাবি আর 
আস্তিনবিহীন কালো কোটে দৃপ্তপদে এসে বঙ্গবন্ধু যোগ দিলেন
নূর হোসেনের মিছিলে—
উত্তর থেকে ছুটে এলেন মঙ্গাভাঙা হাড্ডিসার মানুষ;
মুগুর কাঁধে নগ্ন পায়ে গামছায় মুখ মুছতে-মুছতে
আইল-সরুপথ মাড়িয়ে রাজপথ দাপিয়ে
এলেন অসংখ্য ক্ষেতমজুর,
বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার স্তম্ভ ভেঙে
ছুটে এলেন স্ফীতবক্ষের তিন মুক্তিযোদ্ধা
গগনবিদারি আজ স্লোগানে-স্লোগান
কে আজ রুখবে কারে
ভবনে-ভবনে ওড়ে রক্তনিশান—
ডিআইটির ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে থাকে দ্রুত
সুউচ্চ দালানের ছাদ থেকে
যন্ত্রণায়-ক্ষোভে গলে-গলে পড়তে থাকে
স্মৃতিভারে জর্জরিত বর্শার ফলায় লটকে থাকা দালির চিত্রিত ঘড়ি,
বিকট শব্দে গর্জে উঠল গুলিস্তানের কামান,
সহসা কামরুলের পোস্টার থেকে
একাত্তরের জানোয়ারটা বেরিয়ে এল 
বীভৎস চিৎকারে;
স্বৈরাচারের আলখেল্লা খসে পড়ে,
বেরিয়ে আসে বিষাক্ত শ্বাপদ 
ফণা তুলে—
রাইফেল-বন্দুক আর স্টেনগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে
ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দল সমবেত মিছিলে।
হিটলার-মুসোলিনি-ফ্রাঙ্কো আর রেগান-বুশেরা এসে
মিশে যায় স্বৈরাচারের দলে;
একটা কালো বাজপাখি বিকট শব্দে উড়ে যায়
মাথার ওপর দিয়ে কোনো এক বধ্যভূমির দিকে,
বুলেটের শব্দে প্রকম্পিত হয় দিগ্‌বিদিক
মাটিতে লুটিয়ে পড়েন একঝাঁক সাদা বকের মতো 
নূর হোসেন!
বুক থেকে রক্তের ঝরনা বইতে থাকে
ফিনকি থেকে রক্ত গড়াতে-গড়াতে ঢাকার
রাজপথ, অলিগলি দিয়ে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল পেরিয়ে
লবণাক্ত জলের সঙ্গে গিয়ে মেশে লোহিত-লাল,
ক্ষোভে উত্তাল হয় বঙ্গোপসাগর;
মনসুর হাল্লাজের দেহভস্ম নদীর জলের
সঙ্গে মিশেও যেমনি তুলেছিল সত্যের ধ্বনি
নূর হোসেনের রক্তে-রক্তে তেমনি আজ সমুদ্র গর্জে ওঠে
প্রকম্পিত হয় কবিতার অমোঘ পঙ্‌ক্তিমালা
স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক।
নূর হোসেন! নূর হোসেন!
নূর হোসেনের মিছিল তবু চলতে থাকে;
শুভ্র শিশিরে ঢাকা নূর হোসেনের নিথর দেহ থেকে
ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে আসতে থাকে নূর হোসেন,
পৃথিবীর যত ফিনিক্স পাখি সব এসে দলে দলে
পাখা মেলে নূর হোসেনের মিছিলের ওপরে।
মিছিলে সমবেত সবার প্রতিটি হাত হয় 
এক-একটি নিশান,
প্রশস্ত বুক হয় এক-একটি ব্যানার,
সব চোখ ঝলসে ওঠে বুলেটে-বারুদে
মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে।
জিরো পয়েন্ট পেরিয়ে
এক দুই দশ শত হাজার-হাজার
লক্ষ-লক্ষ হয়ে ছড়াতে ছড়াতে থাকে মিছিল,
নূর হোসেনের মিছিল ছড়িয়ে-ছড়িয়ে পড়ে
হাট-মাঠ-ঘাট, নদী-নালা-খাল-বিল
ধানখেত, বিস্তৃত প্রান্তর ছেয়ে যেতে থাকে,
মানচিত্র লাল হতে থাকে।
মিছিলে যোগ দেয় আমাদের স্মৃতিসৌধ,
মিছিলের সমান বয়সী যত শহীদ মিনার
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, পাড়ায়-পাড়ায় গড়ে ওঠা
বন্দরে-গঞ্জে-গ্রামে, হাটে-মাঠে এখানে-সেখানে
যত্রতত্র যত শহীদ মিনার, সব-সব এসে একে-একে 
যোগ দেয়,
যোগ দিতে থাকে, 
যোগ দিতে থাকে,
মিছিলে মিছিলে।
নূর হোসেনের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে
বিস্তৃত হতে থাকে,
ক্রমাগত বিস্তৃত হতে থাকে...