হামার পেট খারাপ হইল

বকচর গ্রামের তিন দিকে খাল। এক দিকে ইছামতী নদী। নদীর এক পাড়ে মসজিদ, অন্য পাড়ে গির্জা। মাঝখানে শীর্ণ খাল। তবে বর্ষা মৌসুমে ভরাট হয়ে যায় খালটা।

গির্জায় ছিল একজন বিদেশি ফাদার। গ্রামের লোকেরা বলত পাদরি সাব। তাঁর নাম বলতে পারব না, ভুলে গেছি। তাঁর ছিল একটি কালো কুকুর। বর্ষা মৌসুমে ফাদার গির্জার সামনে দাঁড়িয়ে একটি প্লাস্টিকের টেনিস বল ছুড়ে দিতেন পানিতে আর সেই বিলেতি লম্বা কানওয়ালা কুকুরটি সেটা সাঁতরে নিয়ে আসত ডাঙায়।

আমরা অবাক বিস্ময়ে সেই খেলার দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
গির্জার পাশ ঘেঁষে ছিল পাতাবাহারগাছ। হলদে রং নিয়ে সেগুলো মাথা দোলাত।
শুষ্ক মৌসুমে ফাদার যেতেন দূরের একটি গ্রামে। গ্রামের নাম সোনাবাজু। সেই গ্রামে ছিল খ্রিষ্টানদের বসতি। তুইতালে ছিল গির্জা। এখানে স্থায়ীভাবে ফাদার থাকতেন। কিন্তু সোনাবাজুতে কোনো গির্জা ছিল না। তাই ধর্মীয় কাজে তুইতাল থেকে তাঁকে সোনাবাজু যেতে হতো। বর্ষায় নৌকায় আর শুকনায় বাইসাইকেলে।

শুষ্ক মৌসুমে ফাদারকে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে সোনাবাজু যেতে হয়। আমার খ্রিষ্টান বন্ধুদের কাছে শিখেছিলাম, ফাদারকে দেখলেই বলতে হবে ‘যিশু প্রণাম ফাদার’। প্রণাম করাতে তিনি বলতেন, ‘যিশু প্রণাম।’

কখনো কখনো আমি ফাদারের বাইসাইকেলের পেছনে পেছনে দৌড়াতে থাকতাম। তাঁর পরনে থাকত বকলেস লাগানো সার্ট। পায়ে জুতা। মাথায় গোলাকার হ্যাট। একদিন সাইকেলের পেছন পেছন দৌড়াচ্ছি। ফাদার সাইকেল স্লো করে কথা বললেন,

‘টুমার নাম কী? টুমি কি স্কুলে ভর্তি হইবে না?’
আমি বললাম, ‘হ।’
ফাদার জানতে চাইলেন, ‘হ। হ কাহাকে বলে?’
বললাম, ‘হ, মানে হ।’
ফাদার কিঞ্চিৎ হাসলেন। সাইকেলে স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন ‘হ মানে হ। হ মানে হ।’
কয়েক দিন পরে তুইতাল মিশনারি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তির দিন এল।

নাজু আপা আমাকে নিয়ে স্কুলে গেলেন। স্কুলের বারান্দায় ফাদার পায়চারি করছিলেন। আমাকে দেখে ইশারায় ডাকলেন। একজন শিক্ষিকাকে কী যেন বললেন। তিনি আমার হাত ধরে ক্লাস টুতে নিয়ে বসিয়ে দিলেন। ভর্তি হতে চেয়েছিলাম ক্লাস ওয়ানে, ভর্তি হয়ে গেলাম ক্লাস টুতে। মেজ আপা, পালক ভাইও পড়তেন একই স্কুলে।

গির্জার ফাদারকে যেহেতু আমাদের বাড়ির সামনের হালট দিয়ে প্রায় প্রতি সপ্তায় যেতে হয়, তাই আমাদের পরিবারের সবাইকেই তিনি চিনতেন। ছোটরা দৌড়ে গিয়ে বলতাম, ‘যিশু প্রাণাম ফাদার।’

ঈদ এল। মেজ আপা ফাদারকে আমাদের বাড়িতে দাওয়াত দিলেন। তখন ঈদের দিন রান্না হতো খিচুড়ি, ক্ষীর। আর তেমন কিছু হতো না। আমরা খিচুড়ি খেতাম ‘সুদা’। মানে শুধু খিচুড়ি। সঙ্গে মাংস-টাংস কিছুই থাকত না। আচার-জাতীয় কিছু থাকত হয়তো। ফাদার এলেন দাওয়াত খেতে। আমাদের আশপাশের বাড়ির মধ্যে এটা একটা আলোচিত ঘটনা হলো। ঈদে একজন বিদেশি মেহমান এসেছেন।
তিনি ক্ষীর-খিচুড়ি খেলেন।

দুই দিন পর তিনি যাচ্ছিলেন সোনাবাজু। আমাদের বাড়ির সামনে তিনি সাইকেল থামালেন। আমরা দৌড়ে গেলাম তাঁর সামনে। মা একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন।

ফাদার বললেন, ‘খিচুড়ি খাইয়া হামার পেট খারাপ হইল। আমি আর খিছুরি খাইবে না। শুধু ক্ষীর খাইবে।’

ফাদারের কথা শুনে আমরা তো মুখ টিপে হাসছি। পরে এ কথা গ্রামেও ছড়িয়ে গেল। আমাদের মুখে মুখে তখন একই কথা।
‘হামার পেট খারাপ হইল।’
গির্জার সামনে বেশ বড় বাগান। আমার স্কুলবন্ধু কর্নেলিউস রোজারিও একদিন বলল, ‘টমেটো খাবি?’
বললাম, ‘টমেটো আবার কী?’

কর্নেলিউস হাসে। ‘টমেটো চিনছ না? কর্নেলিউস এখন বউ-বাচ্চা নিয়ে নিউইয়র্কে থাকে।
আমি, কর্নেলিউস ও সুনীল সরকার তিনজনে চুপি চুপি বাগানে ঢুকলাম। জীবনে প্রথম দেখলাম টমেটোগাছ। টমেটো পেকে লাল টকটকে হয়ে আছে। আমরা তাড়াতাড়ি কয়েকটি টমেটো ছিঁড়লাম। কর্নেলিউসের বাঁ হাতটা ছিল অবশ। সেই হাত দিয়ে সে কোনো কাজ করতে পারত না। সে দুই হাতের কাজ এক হাতেই করত।

আমরা টমেটো ছিঁড়ে ছুট লাগালাম। চলে এলাম গির্জার বাউন্ডারির বাইরে। এসে বসলাম গির্জার মাঠে। ওটাই হয়তো ছিল জীবনের প্রথম চুরি। চুরিতে হাতেখড়ি হলো।

গির্জার মাঠটা ছিলে অনেক বড়। সবুজ, সুন্দর। খ্রিষ্টান তরুণেরা হাফপ্যান্ট পরে যখন বল খেলত, তখন আমাদের ঈর্ষাও হতো। কারণ, হিন্দু আর মুসলমানদের জন্য কোনো মাঠ ছিল না। আমরা ছিলাম দর্শক মাত্র।

তবে নদীর আরেক পাড়ে ছিল কাউনিয়াকান্দি গ্রাম। সেই গ্রামে ছিল একটি মাঠ। সেই মাঠে কয়েক গ্রামের ছেলেরা বল খেলতে যেত। নদীতে যখন বুক পানি থাকত, তখন বড়রা আস্তে আস্তে লুঙ্গি ওপরের দিকে ওঠাতে থাকত। আমাদের দিকে তাকিয়ে কেউ কেউ বলত, ‘এই, পাছা দেখার চেষ্টা করবি না।’ আমরা না দেখার ভ্যান করতাম। আস্তে আস্তে পানি কমতে থাকত আর সবার লুঙ্গি নিচে নামত।

গ্রামের এপার-ওপার ছিল দীর্ঘ কাঠের পুল। আমাদের পাড়ে মুসলমান বসতি। অন্য পাড়ে হিন্দু বসতি। বাসি মিয়া (বসির উদ্দিন) তখন গ্রামের মেম্বর। আমার মায়ের মামাতো ভাই। তাঁর বাড়িতে ছিল টিউবওয়েল। আশপাশের অনেক গ্রামেই তখন টিউবওয়েল ছিল না। লোকজন দল ধরে আসত টিউবওয়েলের পানি নিতে।

বিকেলবেলা মাঠের মধ্যে ছেলেরা বসে আছে। বড়রাও আছেন। ওপারের বাসন্তীকে দেখা গেল মাটির কলস কাঁখে। সেই দৃশ্য দেখে গ্রামের মানিক বলল, ‘দাঁড়া, একটা খেলা দেখাই।’

বাসন্তী গেল টিউবওয়েলের কাছে। কলসে জল ভরে সেটা কাঁখে তুলে নিল। যেই সে পুলে পা রাখবে, অমনি কলসে হাত ছুঁইয়ে দিল মানিক। আর যায় কোথায়। বাসন্তীর সেটা চোখ এড়ায়নি। অমনি সে কলসটা ফেলে দিল মাটিতে। কলস ফেটে চৌচির।

জাহাজে চাকরি করতেন খইমুদ্দিন দাদা। জাহাজে যারা কাজ করতেন তাদের বলা হত জাহাজী। এ দৃশ্য দেখে ফেললেন তিনি। ডাকা হলো মানিককে। ‘এই খাড়া। কান ধর। কান ধরে দশবার ওঠবস কর।’ মানিক তা-ই করল। তারপর থেকে বাসন্তীর কলস আর কেউ ছুঁইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত না।

গ্রামের দক্ষিণ দিকে ঋষিপাড়া। কষ্টেসৃষ্টে দিন চলত তাদের। কেউ কেউ ঢোল-টিকারা বাজাত। কেউ কেউ বাঁশ-বেতের টুকরি বানাত। খুব অভাবী ছিল তারা। গ্রামে আমরা প্রায়ই দেখতাম নদী দিয়ে মরা গরু ভেসে যেতে। গরু মারা গেলে কেউ আর সেটা মাটিচাপা দেওয়ার চেষ্টা করত না। গাঙে (নদী) ভাসিয়ে দিত।

মরা গরু দেখলেই ঋষিরা ছুটে যেত সেদিকে। তাদের মধ্যে মরা গরুর দিকে যে আগে ঢিল ছুড়তে পারত, সেটা হতো তার। সেই গরু নদী থেকে টেনে আনত পাড়ে। তারপর চামড়া ছাড়িয়ে নিত। চামড়া দিয়ে ঢোল বানাত।

ঝাঁক বেঁধে নামত শকুন। মরা গরু সাবাড় করে ফেলত শকুনেরা। এত বেশি খেত যে কোনো কোনো শকুন নড়তে পারত না। আমরা তার পিছু নিতাম। জড়ো হয়ে যেত অনেক ছেলেমেয়ে। শকুনের দুই পাখা ধরে পুরো গ্রাম প্রদক্ষিণ করতাম। আমাদের অত্যাচারে ধরা পড়া শকুনটা কখনো কখনো বমি করে দিত। এর শাস্তি হিসেবে লাঠি দিয়ে তাকে পিটাত ছেলেমেয়েরা।

কিন্তু আমাদের এ ব্যাপারে বড়রা কখনো বাধা দেয়নি। ব্যাপারটা এমন, খেলছে খেলুক। খেলার তো আর বেশি কিছু ছিল না। দাঁড়িয়াবান্ধা। গোল্লাছুট। অথবা জাম্বুরা-বাতাবি লেবু দিয়ে ফুটবল খেলা।
সেই ঋষিপাড়ার দুজন এখন ঢাকার প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে মালির কাজ করেন।