কে ডিটেকটিভ?

সত্যিই তো, কে ডিটেকটিভ! বিশ্বখ্যাত গোয়েন্দাগল্প লিখিয়ে স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের পাঠকপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমসের কথা দিয়েই নাহয় শুরু করা যাক। হোমস বলতেন, ‘হাউ ক্যান আই লিভ উইদাউট ব্রেনওয়ার্ক!’ আসলেই তা–ই। একজন যুক্তিবাদী, রহস্যপ্রিয় ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ নিজের মগজ না খাটিয়ে কী করে থাকে বলুন! সেই অর্থে যে বা যিনি কৌতূহলী ও মনে মনে সত্যান্বেষণের আগ্রহ পোষণ করেন, তিনিই ডিটেকটিভ। হতে পারে তিনি শখের ডিটেকটিভ কিংবা পেশাদার। তাঁদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একটাই—যখন কোনো ঘটনার পেছনে নিগূঢ় রহস্য বা সন্দেহের উদ্রেক হয়, একজন ডিটেকটিভ তখন আর হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না। জীবিকার প্রয়োজনে, নয়তো শখের বশে তিনি তখন তাঁর কৌতূহলী নাসিকাগ্র সেদিকে বাড়িয়ে দেন। ধোঁয়াশা বা কুহেলির ধূম্রজাল ছিন্ন করতে মন ও মগজ দুটোই সেখানে বেমালুম ডুবিয়ে দেন।

বলা হয়, ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম ডিটেকটিভ গল্প লিখেছেন এডগার অ্যালান পো। তাঁর লেখা ‘দ্য মারডারস ইন দ্য রু মর্গ’ যিনি পড়েননি, আমি দাবি নিয়ে বলতে পারি, তিনি জীবনে বড় কিছু হারিয়েছেন। ১৮৪১ সালে গ্রাহাম’স ম্যাগাজিনে পোর এই গল্প ছাপা হয়। এবং ধারণা করা হয়, এটিই বিশ্বের প্রথম আধুনিক কোনো গোয়েন্দাগল্প। এর আগে এই ধারার লেখা আর কখনো প্রকাশিত হয়নি। এখানে বলে রাখা ভালো, এডগার অ্যালান পোর গোয়েন্দা চরিত্র অগাস্ট ডুপিন, যিনি কিনা স্রেফ গন্ধ শুঁকে আগন্তুকের পেশা, বয়স ও রকমসকম বুঝতে পারতেন। সেই অর্থে ‘হাইলি ট্যালেন্টেড’ ডিটেকটিভ ছিলেন এই ডুপিন সাহেব।

ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়াল! সবার জন্য গোয়েন্দাগল্প নয়, যাঁরা মামুলি প্রেমের উপাখ্যান পড়ে অভ্যস্ত, তাঁদের কাছে ডিটেকটিভ স্টোরি ভালো নাও লাগতে পারে। কারণ, এঁরা শুধু মন বা মনন দিয়ে পড়েন, তাঁরা মস্তিষ্কের ব্যবহারে খুব একটা উৎসুক হন না। শার্লক হোমস যেমনটা বলেছেন, তাঁর পাঠক হতে হবে অনুসন্ধিৎসু, চৌকস ও মেধাবী। আমারও তাই মত। স্রেফ কল্পগল্প পড়ে পড়ে নেশা ধরিয়ে ফেললে তার পক্ষে মগজের চাতুর্যে আস্থা রাখা কঠিন বৈকি। এ ধরনের পাঠক একরকম কাল্পনিক রাজ্যে বসবাস করতে পছন্দ করেন, তাঁরা যুক্তিতর্ক বা কঠিন বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে চলেন। গোয়েন্দাগল্পে তাঁদের অনীহা থাকাটাই স্বাভাবিক।

আগাথা ক্রিস্টি (১৮৯০-১৯৭৬) অন্যতম একজন বিখ্যাত ডিটেকটিভ রাইটার। তবে অনেকেই তাঁকে ক্রাইম লেখকও বলে থাকেন। তাঁর লেখা ‘ডেথ অন দ্য নাইল’ পড়েই অনুধাবন করা যায়, একজন ডিটেকটিভ রাইটার হিসেবে তিনি কতটা সফল! তিনি সৃষ্টি করেছেন বেলজিয়াম থেকে আগত গোয়েন্দা চরিত্র এরকুল পোরো বা পোয়ারো। অ্যালান পোর সঙ্গে আগাথা ক্রিস্টির তফাৎটা হলো এই, পো তাঁর লেখায় যুক্তিতর্ক ও মগজের খেলাকে বেশি প্রাধান্য দিলেও ক্রিস্টি কিন্তু তাঁর লেখায় ক্রাইম বা থ্রিলকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে শেষবিচারে তাঁরা দুজনই ইংরেজি সাহিত্যের অমর ডিটেকটিভ ঔপন্যাসিক বলে খ্যাত।

এখানে একটা প্রশ্ন এসে যায়। জাত বিচারে গোয়েন্দাগল্পকে আমরা ঠিক কোন স্থানে রাখব! এর একটা সহজ উত্তর হতে পারে এমন—যাঁরা গোয়েন্দাগল্পের পোকা, তাঁদের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য হলো গিয়ে ডিটেকটিভ স্টোরি। আর সাহিত্য মানে কিন্তু আসমানি কিছু নয়। লিটারেচার ইজ দ্য রিফ্লেকশন অব লাইফ। সেই অর্থে জীবনের কোনো কিছুই অনাদৃত বা ফেলনা নয়। ডিটেকটিভ স্টোরি যাঁরা লেখেন বা লিখে আসছেন, তাঁরাও জীবন নিয়েই লেখেন। তবে তাঁদের উপস্থাপনশৈলী একটু ভিন্ন। তাঁরা গল্পে চমক আনেন, সেখানে মেধার ব্যবহার থাকে বেশি।

আর জনপ্রিয়তার কথা বলবেন! সেখানে কিন্তু গোয়েন্দাগল্প সবচেয়ে এগিয়ে। বলা হয়ে থাকে, তামাম বিশ্বে বই বিক্রির হিসাবে বাইবেলের পরেই আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমসের স্থান। উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ বা অন্যবিধ রচনা তার ধারেকাছেও নেই। কেন, বাংলা সাহিত্যের ফেলুদাকে দেখছেন না! সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি প্রোদোষ মিত্র ওরফে ফেলুদা। কিংবা ধরুন এপার বাংলার ‘মাসুদ রানা’ সিরিজ কিংবা ‘তিন গোয়েন্দা’। হতে পারে সেটা অনুবাদ, মৌলিক নয়, কিন্তু গোয়েন্দাগল্প তো বটে। মোদ্দা কথা এই, গোয়েন্দাগল্পের প্রচুর পাঠক রয়েছে, কিন্তু সেই তুলনায় বর্তমান সময়ে লেখক তৈরি হচ্ছে না।

এখানে বলে রাখা ভালো, বাংলা সাহিত্যের প্রথম গোয়েন্দাগল্প লিখিয়ে হিসেবে যাঁকে ধরা হয়, তিনি প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। তাঁর পরপরই যাঁর নাম আসে, তিনি হলেন পাঁচকড়ি দে। কিংবা ধরুন ব্যোমকেশ বক্সীখ্যাত শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। এখনো তাঁর গোয়েন্দাগল্প সমান জনপ্রিয়। হালের কথা যদি বলি, তাহলে নাম করতে হয় নীহার রঞ্জন গুপ্তর। আর যাঁর নাম না করলেই নয়, সেই অস্কারখ্যাত সত্যজিৎ রায় এখনো ফেলুদা আর প্রফেসর শঙ্কুর মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন। থাকবেনও।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের এপার বাংলায় উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো ডিটেকটিভ গল্প–লিখিয়ে তৈরি হয়নি। যা কিছু হয়েছে, সব বিদেশি গল্পের অনুবাদ, মৌলিক গল্প নয়। বা হলেও তা বিচ্ছিন্নভাবে।

তাই তো আমরা ‘দ্য ডিটেকটিভস’ শিরোনামে একটি প্ল্যাটফর্ম সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছি। সেখানে যুক্ত আছেন ‘উন্মাদ’খ্যাত নামী লেখক আহসান হাবীব।

ডিটেকটিভ ‘অলোকেশ রয়’ আমার গোয়েন্দা চরিত্র। আরও আছে গোয়েন্দা গুবলু ও রোহান চরিত্র। চৌকস, মেধাবী ও পেশাদার গোয়েন্দা অলোকেশ ইতিমধ্যে বেশ কিছু গ্রন্থে উপস্থিত রয়েছেন। যেমন ‘জলপিপি’, ‘কফিমেকার’, ‘আলিম বেগের খুলি’, ‘অথই আঁধার’ ইত্যাদি। আশা করছি, ডিটেকটিভ অলোকেশ রয় তাঁর প্রজ্ঞা ও ধীশক্তিবলে অনেকটা দূর সামনে এগিয়ে যাবেন। আমাদের প্ল্যাটফর্ম ‘দ্য ডিটেকটিভস’ গোয়েন্দাগল্পপ্রিয় পাঠকের পদচারণে মুখরিত হয়ে উঠবে।