কেলু ও যজ্ঞেশ্বর কাকা

নদীঘেঁষা বাড়ি যজ্ঞেশ্বর কাকার। নদীর ঘাটে বাঁধা থাকত অনেক ‘ভেদি নাও’। নৌকাগুলো বেশ চওড়া। লোকজন জিনিসপত্র আনা–নেওয়ার জন্য তাঁর কাছ থেকে এগুলো ভাড়া নিতেন। নামটা কেন যে ভেদি হলো তা গবেষণার বিষয়! এমনও হতে পারে, ভেদা মাছের মতো চওড়া বলে এই নাম। 

এই নাওগুলোতে করে ঠাকুরও ডুবানো হতো। পূজা আসত। ঢোলের বাড়ি শুনলেই আমরা ভোঁ দৌড় দিতাম হিন্দুবাড়ির দিকে।
একদিন যজ্ঞেশ্বর কাকার বাড়ি গেছি। পূজা হচ্ছে। উঠোনে অনেক লোকজন বসা। একজনকে দেখলাম দেখতে ঠিক যজ্ঞেশ্বর কাকার মতো। তাঁর গলায় ক্রুশ ঝুলছে। রুমশ মামা (রইস উদ্দিন বিশ্বাস) বললেন, ‘মামু, হ্যারে চিনো? হ্যাই হইল যজ্ঞেশ্বরের ছোট ভাই। খ্রিষ্টান হইছে। নাম কেলু। এখন তাঁর পুরা নাম ক্যালেমেন্ট গোমেজ।’

কাকি তাঁকে থালা ভরে বাতাসা–নাড়ু এনে দিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে ক্যালেমেন্ট গোমেজ বললেন, ‘কী, পূজা দ্যাখতে আইছ? আমাগো বাড়িতেও আসবা। বড়দিনের আগাম নিমন্ত্রণ দিয়া দিলাম।’
এত দিন আমার চোখেই পড়েনি বিষয়টা। যজ্ঞেশ্বর কাকার বাড়ি থেকে খ্রিষ্টান কবরস্থান পার হলেই কেলু কাকার বাড়ি। হ্যাঁ, সত্যিই তো রোববার দিন দেখলাম সকালবেলা গির্জার দিকে যাচ্ছেন। মিশায় (প্রার্থনা)।

একই গ্রাম। পাশাপাশি দুই বাড়ি। দুই ভাই। এক ভাইয়ের বাড়ি হয় পূজা। আরেক ভাইয়ের বাড়িতে হয় ক্রিসমাস। কোনো কিছু নিয়ে বিরোধ নেই। এ রকম আরও চোখে পড়ল। বাবা ঋষি। ছেলে খ্রিষ্টান। বেশ কয়েকজন তরুণী মুসলমানও বিয়ে করেছেন।
খালের পূর্ব পাড়ে মসজিদ। আমার আর আমার ছোট বোনের একটা অভ্যাস ছিল শুক্রবার নামাজের সময় মসজিদের আশপাশে ঘুরঘুর করতাম। নামাজ শেষ হলেই যেতাম মসজিদের বারান্দার কাছে। শুক্রবারে মসজিদে নানাজনে ক্ষীর, খিচুড়ি, বাতাসা দিয়ে যেত। সেগুলো মুসল্লিরাও খেতেন বাড়িতেও নিয়ে যেতেন। আমরা যারা ছোট, লাইন ধরে দাঁড়াতাম, আমাদেরও খেতে দিত। আহা রে সেই ক্ষীর! বাতাসা!

কোত্থেকে যে বই পড়ার অভ্যাস হলো জানি না। মা মাঝেমধ্যে পুঁথি পাঠ করতেন বাড়িতে। কখনো কখনো বলতেন, ‘এইবার তুই পড়। পড়ে পড়ে আমাকে শোনা।’ আমি মায়ের পড়ার স্টাইল সহজেই রপ্ত করেছিলাম। মাঝেমধ্যে পুঁথি পড়তাম। আস্তে আস্তে আলমারিতে রাখা বই নাড়াচাড়া শুরু করলাম। একটি বই পেলাম বাঁধানো। সেটাতে লেখা—
প্রিয়তম আজিমাকে—
তোমার আবদুল ওহাব
বইটার নাম আনোয়ারা, লেখক নজিবুর রহমান। খুঁজে পেলাম আরও বই—বিষাদ–সিন্ধু, চরিত্রহীন, পরিণীতা ইত্যাদি। সবই আব্বা কিনেছিলেন। মাকে উপহার দিয়েছিলেন।

আরও বই চাই আমার। মোল্লা দাদা মসজিদে বসে নানা ধর্মীয় বই পড়তেন। একদিন চুপি চুপি ঢুকলাম মসজিদে। দেখলাম বেশ কিছু বই। নামাজ শেষে মুসুল্লিরা চলে গেলে আমি ঢুকে সেই বই পড়তাম।
কিছুদিন পর সেই বই পড়াও শেষ হয়ে গেল। খোঁজ পেলাম তুইতালের বাদল সরকারের কাছে কয়েকটি বই আছে। গেলাম তাঁদের বাড়িতে।

বললাম, ‘আপনে কি আমাকে আপনার বই পড়তে দিবেন?’
বাদলদা বলল, ‘ওই কাম করি না। বই কিনা নিতে পারো।’
বাড়িতে ফিরে এলাম। ঘরের কেবিনে একটি তাকে টিনের একটি কৌটায় টাকাপয়সা রাখতেন মা। আমি সেটা খুলে টাকা নিয়ে ছুটলাম বাদলদাদের বাড়িতে। তিনি আমাকে তিনটা বই ধরিয়ে দিলেন। একটি বই মেঘনাদ বধ কাব্য নিয়ে আলোচনা, আরেকটা পথের দাবি, শরৎচন্দ্রের আরেকটা বইয়ের নাম মনে নেই। বাড়িতে এসে পড়তে শুরু করলাম মেঘনাদ বধ কাব্য নিয়ে আলোচনা। ও মা গো। এ আমি কী কিনলাম! বুঝতে তো পারছি না। পড়তেও পারছি না। নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম। থাক, বড় হয়ে পড়া যাবে।

বড় ভাইয়ের বন্ধু ছিলেন পল গোমেজ। শিকারীপাড়া স্কুলে একই সঙ্গে পড়তেন তাঁরা। তাঁরা দুজনও বই পড়তেন। একদিন দেখি বড় ভাই একটি বই নিয়ে আসছেন। শুরু করে দিলাম পড়া। ওই মুহূর্তে বড় ভাই বইটা খুঁজছিলেন। পড়তে পড়তে মনে হলো বইটা লুকিয়ে পড়া উচিত। আমি বই নিয়ে গেলাম আমাদের নতুন ঘরে। নতুন ঘরে ছিল একটি পালঙ্ক। আমি পালঙ্কের নিচে গিয়ে পড়তে শুরু করেছি আর অমনি দেখি বড় ভাই আমার সামনে দাঁড়িয়ে। তিনি কিছু না বলতেই আমি তাঁর হাতে বইটা তুলে দিলাম।

গ্রামের শাহীনূর আলম আর পুলক ভাইয়ের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব। তাঁরা দুজনই শিকারীপাড়া স্কুলে পড়তেন। শাহীনূর আলমকে আমরা কাকা ডাকি।
তুইতাল স্কুল থেকে ফাইভ পাস করার পর তাঁদের দুজনের সঙ্গে একদিন চলে গেলাম শিকারীপাড়া স্কুলে। তাঁরা আমাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন। কষ্ট হয়েছিল খুব। আমার ইচ্ছে ছিল বান্দুরা হলিক্রস হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার। বড়রা যুক্তি দিলেন, ‘গ্রামের সবাই পড়ে শিকারীপাড়া স্কুলে আর তুই কেন যাবি হলিক্রসে?’

দাদা কখনো কোথাও স্থায়ীভাবে চাকরি করেননি। বছরে হয়তো দু-একবার দু-এক মাসের জন্য চাকরি করতে যেতেন কলকাতায়। দপ্তরি কাজ (বই বাঁধানো)। আবার ফিরে আসতেন বাড়ি। লোকজন দিয়ে হালচাষ করতেন। সে কাজেও তাঁর মন টিকে নাই। আব্বা কলকাতা থেকে টাকা পাঠাতেন। আর দাদা জমিদারি হালে চলতেন। আব্বার ইনকাম বাড়তে থাকলে দাদা জমিজমা কিনতে শুরু করলেন। জমি কিনতেন তাঁর ছেলের নামে আর বউমার নামে।

একবার তিনি মেম্বার ইলেকশনে দাঁড়িয়েছিলেন। মোরগ মার্কায়। তবে ফেল করেছেন। ছোটবেলায় আমরা সেই মোরগ ছাপানো কার্ড নিয়ে খেলতাম।
একটা খেলা ছিল ‘টোপামুছি’। ছোট ছোট মাটির হাঁড়ি–পাতিল দিয়ে খেলা। খেলতাম পুতুল বিয়ে। জামাই-বউ খেলা। সাতচাড়া। এলি (মার্বেল) খেলা। এটা ছিল খুব অসম্মানের খেলা। হালটে হালটে এ খেলা চলত। আর বড়দের দেখলেই আমরা দৌড়ে পালাতাম।

বড়রা নালিশ করত বাড়ি বাড়ি গিয়ে। ‘আপনার পোলা তো এলি খেলে। সাবধান কইরা দিয়েন। তা না হইলে তো নষ্ট হইয়া যাইব।’
আর খেলতাম লাট্টু (লাটিম)। একবার লাট্টু খেলতে গিয়ে রীজু ভাইয়ের পায়ে লাগিয়ে দিলাম। সে কী ভয়ংকর দৃশ্য! লাট্টুর পেরেক দেবে গেল তাঁর ডান পায়ে। রক্ত বের হতে লাগল। তিনি শুধু একবার করুণ চোখে আমার দিকে তাকালেন আর কিছুই বললেন না। পা টেনে টেনে বাড়ি চলে গেলেন। তিনি এক অজানা রোগে মারা গেছেন অনেক দিন আগে। ঘটনাটি আমাকে এখনো কষ্ট দেয়। তিনি কি আমাকে ক্ষমা করেছিলেন?

একদিন গ্রামের জালাল ডাক্তারকে বাড়িতে ডেকে আনলেন মা। হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। মা আমাকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওর খুব বদমেজাজ, ওকে কিছু ওষুধ দেন।’
তিনি কথা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আমার মেজাজ খারাপ শুরু হলো। তিনি ধীরে ধীরে ওষুধের পুরিয়া বানাতে লাগলেন আমার জন্য। আমি টানা এক মাস সেই সাগুদানার মতো ওষুধ খেলাম। মা অনেকটা চিন্তামুক্ত হলেন ছেলের বদমেজাজ কমেছে। কিন্তু না। সাগুদানা খেয়ে মেজাজ ঠিক হলো না। কী আর করা। মা হাল ছেড়ে দিলেন।

একবার কলকাতা থেকে আমার এক মামা এলেন বাড়িতে। আমাদের বাড়িতে অনেক দিন ছিলেন তিনি। একদিন পুকুরে ওচা (বাঁশের তৈরি মাছ ধরার যন্ত্র) দিয়ে মাছ ধরছি। তিনি পুকুরপাড়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী মাছ ধরছ?’
বললাম, ‘ইচা’।

‘ইচা’ ‘ইচা কী?’
আমি মেজাজ খুব খারাপ করে বললাম, ‘এত বড় অইচো আর ইচা চিনো না?’
ইচা মাছের নামই যে চিংড়ি, সেটা আমি অনেক পরে জেনেছি।