এ যেন এক আনন্দ উৎসব

ভোরবেলা ঘুম চোখে বাইরে বৃষ্টি দেখে ধড়মড় করে উঠে বসলাম বিছানায়। সিলেট মানেই বৃষ্টি, যখন তখন আর যেকোনো অবস্থায়। তাই বলে আজকেও হতে হবে? একটু কি দয়ামায়া দেখানো যায় না? এসব ভাবতে ভাবতে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তৈরি হয়ে বাসা থেকে বেরোতেই দেখি একদম থেমে গেছে। যাক বাবা! আর না এলেই হয়। বাস ছাড়বে মদিনা মার্কেট থেকে। আম্বরখানা আর চৌহাট্টা থেকেও উঠবে অনেকে। গন্তব্য মৌলভীবাজার এর মাথিউরা চা–বাগান।

মৌলভীবাজারের মাথিউরা চা–বাগানে বন্ধুরা
মৌলভীবাজারের মাথিউরা চা–বাগানে বন্ধুরা


বাসের ড্রাইভারের জন্য বেশ মায়া লাগছিল। বেচারার বাসটা হয়তো সবাই ভেঙেই ছাড়ত। প্রত্যেকের ভেতরের উত্তেজনাটা বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছিল। আমরা যারা নাচে অত পারদর্শী নই, তারা পেছনে বসে বেসুরো গলায় গান গাইছিলাম আর নিজেদের সুরে মুগ্ধ হয়ে নিজেরাই হাততালি দিচ্ছিলাম। নাশতা দেওয়ার জন্য সবাইকে সিটে বসাতে বেশ বেগই পেতে হয়েছে শাকির ভাইকে।

মৌলভীবাজারের মাথিউরা চা–বাগানে বন্ধুরা
মৌলভীবাজারের মাথিউরা চা–বাগানে বন্ধুরা


বাস থামে চা–বাগানের ভেতরেই করা এক রাবারবাগানে। বাস থেকে নেমেই খুব আফসোস হতে লাগল। কেন জীবনে একটু আঁকাআঁকি শিখলাম না…কোনো চিত্রশিল্পী এখানে থাকলে নির্ঘাত বসে যেত কাগজ আর রংতুলি নিয়ে। সারি সারি রাবারগাছের ভেতর দিয়ে রাস্তাটা এগিয়ে গেছে অনেক দূর। পাশেই ছোটখাটো এক হ্রদ। শীতল বাতাস আর আলতো রোদে হ্রদের পাড়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে উত্তরাধিকার উপন্যাসের অনিমেষ মনে হচ্ছিল। এই বুঝি একদল কুলি-কামিন বাগান থেকে বেরিয়ে আসবে হ্রদে হাতমুখ ধুতে আর আমাদের দেখে থমকে দাঁড়াবে। মাঝেমধ্যে ভাষাও যে মনের ভাব প্রকাশে অপারগ হয়ে পড়ে। তাই যতটুকু পারি ক্যামেরাতেই বন্দী করে নিচ্ছিলাম দৃশ্যগুলো।

ছেলেদের মোরগ লড়াই আর মেয়েদের বেলুন ফাটানো খেলা দেখে কে বলবে এরা বিভিন্ন বয়সের। স্কুলের বাচ্চাদের মতো ডানপিটে যেন সবাই। প্রথম হলেও পুতুলকে হারাতে বেশ কষ্ট করতে হয়েছিল সুমির। একে অন্যের বেলুন ফাটাতে গিয়ে নিজেদের মাথাটাই ফাটিয়ে বসে আর কী! আর নিয়মের ধার তেমন না ধারলেও মোরগ লড়াইয়ে নিজের দক্ষতা ঠিকই দেখিয়েছে রাজীব। সাঈদ ভাই তৃতীয় হলেও হিমাদ্রীর দ্বিতীয় হওয়াটা একটু অবাক করাই বটে। না লড়ে, কেবল বুদ্ধির জোরে যে জেতা যায়, সেটা হিমাদ্রীই সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছিল।

লটারির বুদ্ধিটা যার মাথা থেকে বেরিয়েছিল, তার মতো ফিচলে বুদ্ধি আর কজনের আছে কে জানে। লটারি জেতাটা যে সব সময় খুশির হয় না, তা সেদিন ই বুঝলাম। জসীম, শাবানার অভিনয় থেকে শুরু করে নাচ বা ক্যাটওয়াক কী করতে হয়নি একেকজনকে! পরে বুঝতে পারি, আইডিয়াগুলো ঝুমু আর তামান্নার মাথা থেকেই বেরিয়েছে। যদিও ওরা নিজেরা কিছুই করেনি। তবে যারা অংশ নিয়েছিল, তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে যে কজন তাদের নাম না বললেই নয়। শাকির ভাই আর মিঠু দার নাচ, আনিস ভাই, রাজীব, রনি ভাই আর ববি আপার অভিনয় এবং ইয়াহিয়া আর হিমাদ্রীর গানের কথা ভুলে যাওয়া। আনিস ভাইয়ের অভিনয় দেখে হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল আমার মতো অনেকেই। এ ছাড়াও জাফরের ক্যাটওয়াক আর সুমির সবাইকে রাগানোর চেষ্টা হাসিয়েছে সবাইকে।

মৌলভীবাজারের মাথিউরা চা–বাগানে বন্ধুরা
মৌলভীবাজারের মাথিউরা চা–বাগানে বন্ধুরা


এর ফাঁকে ধামাইল নাচেও যোগ দিয়েছিল কজন। পেটের ভেতর মেঘ না ডাকলে হয়তো সবাই নাচতেই থাকত। লটারির সময় দেওয়া ঝালমুড়িতে কি আর বেশিক্ষণ চলে! তাই দেরি না করে আবার সবাই উঠে পড়লাম বাসে। সবাই জানতাম, এখন খেতে যাচ্ছি। কিন্তু কোথায় যাচ্ছি, সেটা ছিল সারপ্রাইজ। আর এত ভালো সারপ্রাইজ আমি জীবনে খুব কমই পেয়েছি।

হয়তো দিনটাই ভীষণ সুন্দর ছিল, নয়তো সবার সঙ্গে ঘোরাঘুরিতে মনটাও ভালো ছিল, কিন্তু এসব কিছু না হলেও জায়গাটার সৌন্দর্য এতটুকু কম বলে মনে হতো না। বলছি গাজীপুর চা–বাগানে গগনটিলার ওপর অবস্থিত বাংলোর কথা। গেটের কাছটায় এক সারি জবা ফুলের গাছ কিছুটা আভাস দিলেও, ওপরে ওঠার রাস্তাটায় একবারও মাথায় আসেনি বাংলোটা এত সুন্দর হতে পারে। শান্ত নিরিবিলি আর ছায়াঘেরা আঁকাবাঁকা রাস্তাটা বেয়ে ওপরে উঠতে আদ্ধেক ক্লান্ত শরীরের হয়তো কষ্টই হচ্ছিল। টের পাইনি। চোখের সামনের দৃশ্যগুলো যেন মগজটাকে কষ্ট পেতেও মানা করছিল।

মৌলভীবাজারের মাথিউরা চা–বাগানে বন্ধুরা
মৌলভীবাজারের মাথিউরা চা–বাগানে বন্ধুরা


ওপরে উঠে সবচেয়ে আগে যেটা নজরে পড়ে, সেটা হলো জায়গাটার ছিমছাম পরিবেশ। যেন কোনো মস্ত সাহিত্যানুরাগী, উপন্যাসের পাতা থেকে তুলে এনে নিজ হাতে সাজিয়েছেন। নিপুণ হাতে করা ছোট্ট একলাইনের বাগানটা দেখলে যে কেউ মুচকি হাসবে। কোথায় যেন পড়েছিলাম কথাটা, অপূর্ব সুন্দর কিছু দেখলে মানুষ নাকি অজান্তেই মুচকি হেসে ওঠে। শুধু একটা সারিতে লাগানো হরেক রকম গাছগুলো যেন মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানাচ্ছিল আমাদের। বাগানটা ছাড়াও, যেন সবার ‘কী জানি নেই’ অভিযোগটা এড়াতেই বাংলোর পাশে এক–দুটি আম, কাঁঠালের গাছ।

ক্লান্ত মানুষগুলোর সঙ্গে বসে গেলেও কেবলই মনে হচ্ছিল ইশ, যদি পাতাবাহারের ঝোপটা থেকে দুটো কাঠবিড়ালি বেরিয়ে আসত! শাকির ভাইয়ের সঙ্গে একমত হলাম আমিও, এখানে থাকলে এক সপ্তাহেই একটা উপন্যাস লিখে ফেলা সম্ভব। আড্ডা চলছিল সমানে। চোখমুখে ক্লান্তি থাকলেও কথা বলার প্রতিযোগিতায় কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। তবে ক্লান্তির পরিমাণ বোঝা গেল খাবার আগে। কারও মুখে একটা কথাও নেই। অনেকেই হয়তো ‘দ্রুত খাওয়া’য় নিজের ব্যক্তিগত রেকর্ডটাও ভেঙে ফেলেছিল। এক ফাঁকে বন্ধুসভার সভাপতি লেখক দন্ত্যস রওশনের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়। মুঠোফোনে দেওয়া হলো লাউডে, তিনি আমাদের জানাচ্ছে শুভেচ্ছা।

এবার ফেরার পালা। তবে ফেরার আগে গ্রুপ ছবি তোলাটা তো বাধ্যতামূলক। বসে গেলাম সবাই পাশের এক ছোট্ট ব্রিজের রেলিংয়ে। আনিস ভাইও দেরি না করে তুলে ফেললেন বেশ কটা ছবি। তারপর সবাই আবার বাসে। ফেরার পথে অনেকেই ঘুমাতে চাইলেও সুযোগ দেওয়া হলো না কাউকে। শুরু হলো কুইজ পর্ব। প্রসঙ্গ পূর্বনির্ধারিত, কুলাউড়া উপজেলা। প্রথম প্রথম বেশ কটি প্রশ্ন বাতিলের খাতায় ফেলে দিতে হলো। কারণ, উত্তরগুলো সবার জানা থাকায় সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উত্তর বলে দিয়েছে। কিন্তু আস্তে আস্তে প্রশ্নও কঠিন হতে লাগল আর উৎসাহী হাতগুলো ওপরে ওঠাও কমে যেতে লাগল। সবাই শত চেষ্টা করলেও কুলাউড়ার ছেলে শিমুলের সঙ্গে কেউ পেরে উঠল না। কম গেল না ইয়াহিয়াও, প্রায় সমানসংখ্যক উত্তর দিয়ে নিয়ে নিল দ্বিতীয় পুরস্কারটা।

কুইজে ভালো করতে না পেরে ঝিমিয়ে পড়া মুখগুলোকে চাঙা করতে নেওয়া হলো চা–বিরতি। বিরতির পর হয়ে গেল পুরস্কার বিতরণী। বাকিদের কথা জানি না, তবে বাস যখন আবার চলতে শুরু করল কেমন জানি এক মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিল তখন। বাসায় ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়ার তাগাদা যেমন ছিল ঠিক তেমনি ‘ফিরব না আজ আর’, ‘আজকের দিনটা যদি শেষ না হতো’ এ রকম চিন্তাগুলোও ঘুরছিল মাথায়। দু–একজন নিদ্রাদেবীর কাছে ধরনা দিলেও যাওয়ার সময় যেমন ঠিক সে রকম হুল্লোড় করতে করতেই ফিরে আসি আমরা সিলেটে।

মানুষের মস্তিষ্ক নাকি অনেক কিছুই ধরে রাখতে পারে না। মুছে দেয় একসময়। তবে আমি নিশ্চিত, বুড়ো বয়সে যখন কাউকে এই গল্পটা বলব একটা লাইনও বদলাবে না। দিনটি এত সুন্দরভাবে কেটেছে যে মস্তিষ্ক চাইলেও একে মুছে দিতে পারবে না।