নিজেকে ভালোবাসেন তো!

২০১৩ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের একজন প্রফেসর ৭৫ বছর ধরে চলছিল এমন একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করতে গিয়ে সবাইকে চমকে দিলেন। গবেষণার বিষয় ছিল - ‘একটা সুন্দর সুখী জীবনের জন্য কোন জিনিসটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?’ ফলাফল আসলেই চমকে দেওয়ার মতো। টাকাপয়সা না, খ্যাতি না, ধনদৌলত না, ক্ষমতা না। এটি হলো সম্পর্ক। সুসম্পর্ক। ছান্দিক একটা সম্পর্ক নিজের পরিবার, বন্ধু আর প্রতিবেশীদের সঙ্গে যা অন্যতম উপাদান একটি সুন্দর সুখের জীবনের জন্য।
সত্যিই তো, একটু নিজের ভালো থাকা নিয়ে ভেবে দেখুন তো...। আপনি কি জানেন বাবা-মা সব থেকে বেশি সুখ অনুভব করেন, যখন তাঁদের সন্তানদের নিয়ে একসঙ্গে ভালো সময় কাটান। একবার ভাবুন অনেক ধনী দুজন দম্পতির কথা, যাঁদের কোনো সন্তান নেই। আবার আরও ভাবুন, আমরা কি শুধু পরিবার নিয়েই ভালো থাকি? একদম না। আমাদের নানা বিপদে-আপদে, উৎসবে বা অকারণে প্রতিবেশী আর বন্ধু যাদের সঙ্গে সরাসরি রক্তের বা আনুষ্ঠানিক কোনো সম্পর্ক না থাকলেও তাদের বাদ দিয়ে ভালো থাকা হয় না আমাদের।

সুতরাং সুখ-শান্তি মিলিয়ে ভালো থাকার অন্যতম উপাদান ছান্দিক এই সুসম্পর্কগুলো। কিন্তু অনেক বড় প্রশ্ন হলো, কীভাবে সম্পর্কে ছন্দ এবং সৌন্দর্য যোগ করব? এ ক্ষেত্রে গবেষণা বলছে সম্পর্ক হয় একটা মানুষের আত্মার সঙ্গে আরেকটা মানুষের আত্মার। আর এ কারণেই হয়তো বাংলা প্রতিশব্দটি হলো আত্মীয়।
সম্পর্কে ছন্দের অভাব হয় তখনই, যখন আমরা আত্মার প্রয়োজনের তুলনায় শরীরের প্রয়োজনকে বেশি প্রাধান্য দিই। খেয়াল করে দেখুন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানসহ সব মেটেরিয়াল হলো শরীরের জন্য। কিন্তু আত্মার বা হৃদয়ের প্রয়োজন একটু ভিন্ন আর তা হলো বিশ্বাস, সম্মান, শ্রদ্ধা, গৌরব, যত্ন, ভালোবাসার মতন অমূল্য সব অনুভূতি। আমাদের প্রিয়জনদের সঙ্গে ভালোবাসার এই সম্পর্ক ছান্দিক, সুখময় ও শান্তিতে পরিপূর্ণ করতে গেলে প্রয়োজন তাদের জন্য ওপরের ওই বিশেষ অনুভূতিগুলো নিয়মিত ও পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করা।

এখন আবারও আরেকটি প্রশ্ন—যদি আপনার একটা সুন্দর কাচের পানি খাওয়ার জন্য মগ থাকে আর সেটি যদি সম্পূর্ণ খালি থাকে তাহলে কি কাউকে একটুও পানি দিতে পারবেন? না, আপনার মগই শূন্য, তাহলে অন্যকে কীভাবে দেবেন! সুতরাং নিজেকে আগে ভালোবাসতে হবে, যদি অন্যকে ভালোবাসতে চান। নিজের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক হতে হবে মধুর, ছান্দিক। তবেই তো অন্যের সঙ্গে ছান্দিকতা ফিরে পাবেন। তাহলে আবার প্রশ্ন চলে আসে মনে, কীভাবে নিজের সঙ্গে সম্পর্ক পাকা করব? ওই যে একই পদ্ধতি। নিজের প্রতি নিজের বিশ্বাস, নিজেকে সম্মান, শ্রদ্ধা ও যত্ন করতে হবে।
নিজের প্রতি যত্নশীল হলেই, আত্মবিশ্বাস ও আত্মশক্তি বেড়ে যায়। অন্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে এই শক্তি অত্যাবশ্যকীয়। আর এমন সব অভ্যাস গড়ে তুলতে প্রয়োজন বিকশিত মন।

বিকশিত মনের নকশা
ঈগলের বাসায় হামলা। অদম্য ঈগল জানপ্রাণ দিয়ে নিজের তা দেওয়া ডিমটা  রক্ষা করে একটা মুরগির খাঁচায় রেখে এল। মুরগি নিজের ডিম মনে করে ঈগলের ডিমটিও তা দিল। একসঙ্গে মুরগির বাচ্চাগুলোর সঙ্গে বড় হতে লাগল ঈগলের বাচ্চাটাও। একঝাঁক মুরগি, দলনেতা মা নিজেও মুরগি, এমন অবস্থায় ঈগল নিজেকে মুরগি ছাড়া আর কী ভাববে? নিজের ওড়ার অদম্য শক্তি থাকা সত্ত্বেও কখনো ঈগল পাখিটি চেষ্টাও করল না ডানা মেলে ওড়ার। কেন? শুধু ছকেবাঁধা মাইন্ডসেট বা মনের নকশার জন্য। পারা না পারা তো অনেক পরের কথা। শুধু মনে মনে যদি ভেবে নিই যে আমি পারব না, তাহলেই সব দুয়ার বন্ধ। আমাদের মন সব সময় একটা নকশা অনুসরণ করে চলে। সিদ্ধান্ত এবং কাজ যা কিছু করে তা সেই নির্দিষ্ট নকশা মেপে।

কারও কারও ক্ষেত্রে এই নকশা পূর্ব নির্ধারিত, আবার কেউ কেউ নিজের মনকে এমনভাবে প্রস্তুত বা নকশা করে রাখে যে প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য আচরণ  করতে পারে। এমন যদি হতো আমি পাখির মতো। চিন্তা করে দেখো তো মানুষ পাখি হতে না পারার কারণে যদি ভাবত আমরা উড়তে পারব না, তাহলে কিন্তু উড়োজাহাজে  ওড়ার স্বপ্ন ভুলেও দেখত না। পাখি না হয়েও, ডানা না থাকলেও তুমি উড়তে পারো। আর এমন সব মুক্তচিন্তা বা স্বপ্ন দেখা, কী নেই তা নিয়ে না ভেবে কী আছে এবং আরও কী হতে পারে তা নিয়ে ভাবে এই বিকশিত চিন্তাধারার মানুষেরা।

আর গণ্ডির মধ্যে একই ধরনের চিন্তা করা মানুষ শুধু অভিযোগ করে আর বলে এটা নেই ওটা নেই। আমি পারব না। আমার মেধা থাকলে দেখিয়ে দিতাম। সুচিন্তা করার মতো কিছুই খুঁজে না পেয়ে সারা দিন দুশ্চিন্তা করে আর অন্যদের ওপর দোষারোপ করে। এরকম অনুর্বর চিন্তার জন্য ব্যক্তি নিজে সম্পূর্ণ দায়ী না। বরং অনেক দিন ধরে অনুশীলন ও অনুসরণ করা মাইন্ডসেট বা মনের নকশা। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসা খুব কঠিন না, আবার একেবারে সহজও না।

ফিক্সড মাইন্ডসেট থেকে বেরিয়ে, গ্রোথ মাইন্ডসেট অর্জন করতে পারলে জীবনকে সহজভাবে উপলব্ধি করা যায় এবং সমস্যাগুলো সমাধানের নতুন ও অভিনব উপায় খুঁজে পাওয়া যায়। আসুন, বিজয়ের আনন্দে মুক্তির এই দিনে নিজের মনকে মুক্ত করে সত্যিকারের স্বাধীনতা উপলব্ধি করি। হয়ে উঠি অদম্য। শুধু টিকিয়ে রাখা নয়, গড়ে তুলি টেকসই সম্পর্ক। 

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক, প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ

তারুণ্যের অষ্টম সংখ্যা থেকে নেওয়া