আম্মা

আম্মা
আম্মা


‘খুশিদালম, কয়েক দিন তোকে পড়ালেখায় মনোযোগী মনে হচ্ছে না!’— নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখায় তাগাদা দিতে আম্মা এটুকুই বলতেন। আর এ কথা বললে খু্বই লজ্জায় পড়ে যেতাম। টনক নড়ত আমার। ঠিকই তো, গত কয়েক দিন পর্যাপ্ত পড়ালেখা করিনি!

আমি মো. খোরশেদ আলম। বাড়ি কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া। ছয় ভাইবোনের মধ্যে আমি তৃতীয়।
চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াকালীন হার্ট অ্যাটাকে আব্বু মারা যান। আম্মার জীবনে সবচেয়ে কঠিন সময়টুকু শুরু তখন থেকেই...
আব্বু আমাদের বড়ধুশিয়া গ্রামে আড়ংয়ে ব্যবসা করতেন। হলুদ, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি বিক্রির ব্যবসা। ব্যবসায় দেনা-পাওনা থাকেই।
আব্বু মারা যাওয়ার পর দেনা পরিশোধ করতে পরিবারে হিমশিম অবস্থা। এদিকে পাওনা টাকা পাইনি সিকি ভাগও।

বড় ভাই মোরশেদ আলমের ঘাড়ে পুরো সংসার। আম্মা সে সংসারের পরিচালক। তিনবেলা খাওয়া—আহ! সে কী কষ্ট! তবে হলফ করে বলতে পারি, এ দুজন আমাদের উপোস রাখেননি।
অভাবে সয়লাব সংসার হলেও আম্মা বলতেন, ‘বারবার খাবি না। দিনে তিনবেলা পেটভরে ভাত খাবি।’
খেতামও তিন প্লেট ভাত। আসলে তখন ওইভাবে বুঝতাম না পরিবারের হিমশিম অবস্থা। চাল ঘরের হলেও অন্যান্য খরচাপাতি আসে কোথায় থেকে! এদিকে বাইরে সবাইকে আম্মা বলত, ‘এখনই তো ওদের খাওয়ার বয়স। বড় হলে এমনিতেই মানুষের খাবারের টান কমে যায়!’
আসলে মনে হয় না, আগের মতো ভাত খাই এখন।

আম্মা আমাদের বড় হওয়া দেখে যেতে পারেনি। নবম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় আম্মার ক্যানসার ধরা পড়ে। যকৃৎ ক্যানসার। পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে প্রাথমিক বৃত্তি পাওয়ায় আম্মা খুব খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু ক্যানসার-যাতনায় আমার অষ্টম শ্রেণির ট্যালেন্টপুলে জুনিয়র বৃত্তি পাওয়ার আনন্দ আম্মা ওইভাবে নিতে পারেনি!
সেবার জুনিয়র বৃত্তির ফলাফল কিছুটা দেরিতে দেয়। সাধারণত মার্চ-এপ্রিলে দিলেও ২০১১ সালে দিয়েছিল জুনের দিকে। আম্মার অসুস্থতার লক্ষণগুলো ঠিক তখন ছিল খুবই প্রকট। মুমূর্ষু অবস্থা।

সাধ্যমতো চিকিৎসা করি আম্মার বেঁচে থাকা শেষ কয়েক মাসে। তাঁর জীবনের শেষ কয়েক দিন এত কষ্টে যায় যে আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম,‘হে আল্লাহ, আম্মাকে এত কষ্ট দিয়ো না। হয় সুস্থ করে দাও, না-হয় যত দ্রুত নিয়ে যাও!’
আমার আম্মা সুস্থ হননি। ২৪ অক্টোবর, সোমবার সন্ধ্যা, ২০১১। খুশিদালমদের ছেড়ে চলে যান!

আসলে আম্মা মানে নবম শ্রেণি, আব্বু মানে ফোর—এই দুয়ের মধ্যেই যেন আমার জীবনঘোর।

এসএসসি এবং এইচএসসি উভয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এ+ পেলাম। এখন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে।
মা দিবসে আমার ষষ্ঠ সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু। আর জীবন পরীক্ষা তো প্রতিদিনই দিই। সবাই-ই দেয়। আপনিও দেন। পাসও করেন। তাই বেঁচে আছেন।

‘আমার সোনার ময়না পাখি’ গানটি আমার খুবই প্রিয়। অভাব-অনটনের মধ্যেও ঘরে মাঝেমধ্যে মজার আড্ডা হতো। আড্ডায় আম্মাকে গানের কথা বললে এ গানটিই বেশি গাইতেন।
এ গানটি অনেকের কাছে ভাবার্থ কিংবা অন্য কোনো কারণে ভালো লাগে। আমারও ভালো লাগে, তবে আম্মার কণ্ঠে বারবার শোনা গান বিধায়।

যাই হোক, আজ এতটুকুই...

অ...আচ্ছা একটা কথা, আমাদের এলাকায় খোরশেদ আলম নামটাকে ‘খুশিদালম’ বলে ডাকা হয়। মোরশেদ আলমকে ‘মুর্শিদালম’!

প্রথম আলো বন্ধুসভা, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়