আপা বনাম মা স্যালুট তোমাকে

আপার সঙ্গে আমার বয়সের পার্থক্য আট বছর। আট বছরের মেয়ে খুব বড় না হলেও যৌথ পরিবারের অনেক ভাইবোনের মধ্যে থাকা আট বছরের মেয়ে, তা–ও বড় মেয়ে হলে পরিবারের অজান্তেই সে আসলে বড়দের সারিতেই পড়ে। মা যখন সব সন্তান সামলে সংসারের সব ভারে নুব্জ হয়ে যায়, তখন এই আট বছরের মেয়ে হয়ে ওঠে মাকে সাহায্য করার প্রধান সহযোগী।

তো এই আট বছরের আপা হয়ে উঠল ছোট ভাইবোনের দেখাশোনার জন্য মায়ের ভূমিকা পালনকারী। আমি সবার ছোট হওয়ার কারণে আপার মায়ের মতো ভূমিকা আমার ওপরই বেশি ছিল। অন্যায় করলে মা আমাকে বকা বা মার দিলে এই আপাই পিঠ পেতে দিত, কাঁদতে কাঁদতে বলত, ওকে না মেরে আমাকে মারো। বলত, মা ও অসুস্থ থাকে, ওকে মেরো না বা বকা দিয়ো না। রাত-বিরাতে হাঁপানির জন্য ঘুম থেকে জেগে উঠলে মায়ের পাশাপাশি আপাও রাত জেগেছে, বিকেলে মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘুরিয়ে এনেছে। চোখ বন্ধ করলে এখনো দেখতে পাই আপা আমাকে গোসল করিয়ে থুতনিটা ধরে চুল আঁচড়ে দিচ্ছে আর আমি বলছি, ‘ইশ্‌ থুতনিটা ছাড় না, ব্যথা লাগে তো!’ পড়তে বসানো, বিকেলে এটা–ওটা নতুন নতুন জিনিস বানিয়ে নাশতা সামনে এনে ধরা, ঘুমের সময় দোয়া শেখানো, দুপুরে রেডিওতে নাটক শোনা—সব আপার সঙ্গে সঙ্গে করা যেন ছিল মাকে কাছে পাওয়ার বিকল্প। সেই আপার মধ্যে মাতৃত্ব এসেছিল ওই আট বছর বয়সেই। সেই আপা যখন সত্যি সত্যি মা হলো, তার আনন্দ কতখানি আমাদের সবার জন্য, তা বলাই বাহুল্য।

আমরা সবাই জানি, মা হওয়াটা কত কঠিন, কত কষ্টের, খুব সহজ সাধারণভাবে। একটা মা যা যা পার করে মা হয়ে উঠে, তার সে কষ্ট আর ত্যাগের কোনো তুলনা নেই। সে কষ্টটা সবাই বোঝে, সবাই স্বীকার করে। তবে যারা গিফ্টেড চাইল্ড বা বিশেষ বাচ্চার মা হয়, তাদের কষ্টটা কি কেউ বোঝে? না, বোঝে না। বরং সেসব মায়ের কষ্টের বোঝাকে আরও বাড়িয়ে দিতে অন্য মায়েরাও পিছপা হয় না।

আমার আপার প্রথম সন্তান আল্লাহ তাআলার বিশেষ উপহার। অপরূপ সুন্দর দেখতে এই বাচ্চা শারীরিকভাবে বাড়তে থাকলেও মনের বিকাশ তার একটা জায়গায় আটকে গেল। ছয় মাস থেকে যখন এই শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ হতে থাকল না, তখন কেউ না বুঝুক, আপা কিন্তু ঠিক বুঝতে পারল। কিন্তু কাউকে বিশ্বাস করাতে পারল না। কেউ মানতে রাজি নয় যে বাচ্চাটির কিছু অস্বাভাবিকতা আছে। প্রতিটি দিনের বর্ণনা দিতে গেলে একটা পুরো বই লেখা হয়ে যাবে। শুধু এটুকু বলি, বাচ্চা যখন মাকে চিনে না, তিন–চার বছর হয়ে যাওয়ার পরও মা বলে ডাকে না, তখন মায়ের বুকের ভেতর কী যে কষ্ট হয়, তা একমাত্র ওই সব মা–ই জানে। এর ওপর তো আছেই পাড়াপ্রতিবেশীর বাঁকা চাহনি—‘ওর বাচ্চাটা না স্বাভাবিক নয়!’

সমাজের বাইরে পরিবারের বাইরে একঘরে হয়ে যাওয়া এসব মায়ের যুদ্ধটা ভীষণ রকম কঠিন। আমার আপা সে যুদ্ধে কতটা জয়ী হয়েছে, সে বিশ্লেষণ করতে যাব না। এটুকু বলব, তার সর্বোচ্চ চেষ্টা সে করেছে এবং করে চলেছে। এই পরিবারে আরও অন্য সন্তানগুলোকে সঠিক–স্বাভাবিক পরিবেশে বড় করাও কিন্তু  সহজ নয়। অন্য সন্তানগুলোর মনে হতে থাকে, মা আমাকে নয়, আপুকে বেশি যত্ন করছে, মনে হয় আমি অবহেলিত। আরও অনেক কিছু। সে পরিবারে আপা তার আরও দুটি সন্তানকে বড় করে তুলতে যে ভূমিকা পালন করছে, তা অতুলনীয় । আমি আমার মা হয়ে ওঠা জীবনে এটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। মা একদিনে মা হয়ে ওঠে না, মা হতে যে শত কষ্ট সহ্য করতে হয়, তা মায়েরা এক দিনেই শেখে না, সন্তানের ভালোবাসা, সন্তানের আদর মাকে সেসব করতে শক্তি জোগায়। সন্তানই আসলে মাকে প্রতিনিয়ত মা করে গড়ে তোলে। তাই একটা সহজ স্বাভাবিক বাচ্চার মা হওয়া যত সহজ, একটা বিশেষ বাচ্চার মা হওয়া তত সহজ নয়, তার যুদ্ধটা একেবারেই অন্য রকম।

সন্তানের অসহায়ত্ব মাকে মনে মনে কতটা পঙ্গু করে রাখে, তা আপার চোখের দিকে তাকালেই দেখতে পাওয়া যায়। শুধু দেখতে–জানতে হয়। মুখে হাসির মধ্যে চোখের মধ্যে যে বিষণ্নতা ছড়িয়ে থাকে, তাতে লুকিয়ে থাকে শতসহস্র কান্না।
আপা তোমাকে স্যালুট; মা তোমাকে স্যালুট; তোমার মাতৃত্বকে স্যালুট।

ডালাস, টেক্সাস
সদস্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা।