মায়ের ভালোবাসা

খুব ছোটবেলায় ঘরছাড়া হয়েছি, বয়স যখন সবে মাত্র ছয় কি সাত বছর। পড়ালেখা করেছি হোস্টেলে থেকে। জেএসসি দেওয়ার বছর হোস্টেল থেকে বাসায় এসেছি। যে সময়টা মায়ের স্নেহ পাওয়ার, মায়ের আঁচলের নিচে ঘুর ঘুর করার, তা কেটেছে হোস্টেলের চার দেয়াল আর লোহার শিকের বিশাল গেটে বন্দী থেকে। তাই উঠতে বসতে, খেতে কিংবা ঘুমাতে মায়ের আদর খুব কমই পেয়েছি। মাঝখানে এসএসসি এবং এইচএসসি মিলিয়ে চার বছর বাসায় ছিলাম। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে আবারও বাসা ছাড়তে হলো। আমার এই ২২ বছরের জীবনে মায়ের ভালোবাসাগুলো তাই আমার কাছে এসেছে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের আকারে, যা শেষ হয়েও কখনো হয় না শেষ। বিশ্ব মা দিবসে তাই আমার মায়ের ভালোবাসা নিয়ে লিখতে বসেছি ভালোবাসার সেই ছোট গল্পগুলো।

ছোটবেলায় পড়েছিলাম চট্টগ্রামের একটি কওমি মাদ্রাসায়। চারদিকে উঁচু সীমানাপ্রাচীর আর বিশাল লোহার গেটে বন্দী ছিল আমার শৈশব। বাবা তখন সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত। চট্টগ্রামের বাইরে বাবার পোস্টিং হলে সপ্তাহান্তে আমাকে দেখতে আসতেন মা। তখনো মোবাইল ফোন এতটা সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি। তাই এই দিনটার জন্য আমি অধীর অপেক্ষায় থাকতাম, লোহার গেটের ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারতাম, যদি মা আসে। এভাবেই কোনো দিন বিকেলে মা চলে আসতেন, সঙ্গে নিয়ে আসতেন আমার পছন্দের চিংড়ি মাছের তরকারি, মায়ের হাতের রান্না করা ভাত। কখনো নানা পিঠাপুলি। ঘণ্টা দেড়েক সময় থাকত অভিভাবকের সঙ্গে সাক্ষাতের। তারপর আমি চলে আসতাম লোহার গেটের ভেতরে। আমি যতক্ষণ চোখের আড়াল না হতাম, মা ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন গেটের ওপারে। আমি পিছু ফিরে চাইতাম। গেটের ফাঁকফোকর দিয়ে মায়ের আবছায়া উপস্থিতি দেখতে পেতাম। এভাবেই সেই প্রতিষ্ঠানে কেটেছে আমার শৈশব-কৈশোর। কেটেছে কত বিকেল কখনো মায়ের জন্য অপেক্ষায়, কখনো লোহার গেটের ওপারে মায়ের আবছায়া উপস্থিতি দেখে, অনুভব করে।

কদিন আগে প্রকাশিত হলো মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল। চারদিকে যখন জিপিএ-৫ নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের উচ্ছ্বাস, তখন ব্যতিক্রম এক মা। প্রথম আলোর আলোকচিত্রীর ক্যামেরায় ধরা পড়ে ভিন্ন এক ঘটনা। মেয়ে জিপিএ-৫ পায়নি, তবু মেয়ের ললাটে এঁকে দিচ্ছেন অভয়, স্নেহের নিবিড় চুমো। ছবিটি ভাইরাল হয়, ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। চোখে পড়ে আমারও। ছবিটি দেখে ফিরে যাই ২০১৫ সালে। সেবার আমি এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম। পরীক্ষা শেষে যথারীতি ফলাফল প্রকাশিত হলো। অল্পের জন্য জিপিএ-৫ ছুটে গেল। রেজাল্ট জানার পর ভয়ে বাসায় না এসে প্রথমে যাই খালার বাসায়, এরপর গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি কলেজের গেটে। রেজাল্ট জানাই বড় ভাইয়াকে। তারপর ভাইয়া এলে একসঙ্গে বাসায় যাই। আম্মুকে রেজাল্ট জানাই। ছবির ওই মায়ের মতো আমার মা আমার ললাটে চুমো এঁকে দেননি। কিন্তু দিয়েছিলেন অভয় বাণী, কটি শব্দে দিয়েছিলেন একরাশ ভালোবাসা।

একই পরীক্ষার মাত্র এক মাস আগে আমি বিশেষ কারণে পারছিলাম না পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে। তখনো আমার শেষ ভরসা আমার মা। মাকে সমস্যার কথা বলেছিলাম ভয়ে ভয়ে। আমার ভয়টা ছিল নিতান্তই অমূলক, কেননা ততক্ষণে যে মা আমার মাথার ওপর মেলে ধরেছিলেন স্নেহ, আর সাহসের ছায়া।

মাস আটেক আগে হঠাৎ অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সহায়তায় কুমিল্লা সদর হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছি। রাত তখন প্রায় ১১টা ৩০ মিনিটের মতো ছিল। আব্বুর অফিসে নৈশকালীন ডিউটি, বড় ভাইও বাসায় নেই। ছোট ভাইকে আমাকে দেখার জন্য রেখে তখনই মা বেরিয়ে পড়েন প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুধের খোঁজে। মায়ের হাত দিয়ে বেশি ওজন বহন করা ডাক্তারের নিষেধ। কিন্তু সেই রাতে মা ওষুধসহ ফলমূলের ভারী ব্যাগ বয়ে নিয়ে এসেছিলেন ঐশ্বরিক শক্তিতে। শুধু তা-ই নয়, মা তাঁর এই অসুস্থ হাত দিয়েই প্রতি শীতে আমাদের ভাইদের জন্য বানান নানান পিঠাপুলি। গ্রামে বেড়ে ওঠা আমার মা বলেন, ‘সামনে যে সময় আসছে, কপালে এসব পিঠাপুলি নাও জুটতে পারে, তাই যত দিন বেঁচে আছি, তত দিন তোদের বানিয়ে খাওয়াই। পরে যাতে আফসোস না করতে হয়।’

যখন লেখাটা লিখছি, তখন ভাবছি, মায়ের এই ভালোবাসার প্রতিদান দিতে পারব তো?প্রার্থনা করি, আমার মা হোক শতবর্ষী।
শৈশব-কৈশোরের পুরোটা সময় কাটিয়ে ছিলাম ঘরের বাইরে, হোস্টেলে। জীবনের এই পর্যায়ে এসে উচ্চশিক্ষা অর্জনে এখনো ঘরের বাইরে। আগে মা আমাকে দেখতে আসতেন, এখন ক্লাস, মিডটার্ম, সেমিস্টার, টিউশনির নানা ব্যস্ততার মধ্যে দুই মাস, তিন মাস পরপর আমি মাকে দেখতে যাই। দু-এক দিন বাসায় থেকে যখন কুমিল্লায় ফিরতে বের হই, মা তখন আমার সঙ্গে সঙ্গে আসেন। আমি রাস্তায় উঠি, পিছু ফিরি। দেখি, মা মুখে আঁচল টেনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি গাড়িতে উঠি, গাড়ি চলতে শুরু করে। রাস্তায় তাকিয়ে দেখি মা হাত নাড়ছেন, বিদায় জানাচ্ছেন। ভালো থাকিস, বাবা!
সাবধানে যাস।

দুর্যোগ ও ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা