জয় নয়, জানাটাই জরুরি

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

বিতর্কের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক কী, এ বিষয়ে জানতে হলে আমাদের জানা দরকার শিক্ষা কী? শিক্ষা হলো আচরণের কাঙ্ক্ষিত ও অপেক্ষাকৃত দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন। এখানে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন কীভাবে হবে? হবে নতুন নতুন বিষয় জেনে ও সমাজের জন্য দায়বদ্ধতা থেকে। বিতর্ক আমাদের কিছু প্রশ্ন ও সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়। ‘আমি ঠিক, অন্যরা ভুল’—এমন চিন্তার মানুষের সংখ্যাই বেশি। এমন চিন্তা থেকে বের করে আনে বিতর্ক। বিতর্ক পরমতসহিষ্ণুতা শেখায়। নিজের বিশ্বাসকে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতে শেখায়। বিতর্কের ক্ষেত্রে সক্রেটিসের উক্তি—‘অ্যান আনএক্সামিনড লাইফ ইজ নট ওরথ লিভিং।’

বিতর্ক ব্যক্তিকে আলোকিত হতে শেখায়, মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন হতে শেখায়। যদি তা না–ও পারে, অন্তত এতটুকু উপলব্ধি করতে শেখায় যে সে নিজে আলোকিত কি না। ‘কোনো নির্দিষ্ট বিষয়কে যুক্তির মাধ্যমে উপস্থাপন করাই হলো বিতর্ক।’ এ ক্ষেত্রে অন্যজনের বক্তব্য একবারে ফেলে দেওয়া যাবে না। ভলতেয়ার বলেছিলেন, ‘তোমার মতের সঙ্গে আমি একমত না–ও হতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি জীবন দিতে পারি।’ মনে হয় এখানে বিতর্কের আসল উদ্দেশ্য জানানো হয়েছে।

অনেকেই মনে করেন, বিতর্কে জয়টাই মুখ্য। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, জয়-পরাজয়ের চেয়ে কিছু শেখাই হলো বিতর্কের মূল উদ্দেশ্য। এটি শুধু আনুষ্ঠানিক বা প্রতিযোগিতামূলক নয় বরং একাডেমিক ক্ষেত্রে এর সুফল অনেক বেশি। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এটির আরও চর্চা প্রয়োজন। এ কারণে বিতর্কের প্রসার হওয়া আরও জরুরি। পছন্দ হোক আর না হোক, প্রতিপক্ষের একজনের বক্তব্য একজন বিতার্কিককে মন দিয়ে শুনতে হয়। এই চর্চার মাধ্যমে যুক্তিবাদী, মুক্তচিন্তা ও গণতন্ত্রের জন্য একটি বিরাট জনগোষ্ঠী তৈরি হবে। খুব অল্প কথায় এটাই বিতর্ক।

বিতর্কের প্রস্তুতির বিষয়টি নিয়ে লিখতে গেলে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে বিতর্ক কেন করি, এটি আমার জীবনে কেন প্রয়োজন? আমি একজন বিতার্কিক কিন্তু প্রথমেই আমি একজন শিক্ষার্থী। আজকাল অনেকেই নিজেকে শিক্ষার্থীর চেয়ে একজন বিতার্কিক পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। অথচ দেখা যায় হয়তো তার বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজজীবনের প্রথম সেমিস্টার বা প্রথম বর্ষ ভালো ফল অর্জন করে শেষ করতে পারেনি।

যে বিতার্কিক তার একাডেমিক জীবনে ভালো ফলের দিকে নজর দেয় না, সে কখনোই ভালো বিতার্কিক নয়। কারণ, এখানে নিশ্চিত হওয়া যায়, সে পড়ালেখা না করে শুধু উপস্থাপনের মাধ্যমে মানুষের হাততালি বা মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা করছে। কারণ, বিষয়ের গভীরতা থাকে না বরং ঘুরেফিরে সব বিতর্কে একই কথা চলে আসে। যেমন এই সময়ে যদি বিতর্কের বিষয় হয় ‘বিজ্ঞানের এই যুগে দর্শন অপ্রাসঙ্গিক’, তাহলে দেখা যাবে বিজ্ঞান বা দর্শন কোনো দিকে না গিয়ে বিতার্কিকেরা হয়তো আমেরিকা, সাম্রাজ্যবাদ, ইরাক-ইরান, আফগানিস্তান-পাকিস্তান ইস্যু অথবা চীন, ভারত ও বাংলাদেশের বাণিজ্যনীতি নিয়ে আলোচনা করছে।অতিসাম্প্রতিক বিতর্কে বিচারক থেকে তা–ই লক্ষ করছি। বর্তমান সময়ের বিতার্কিকেরা খুব কম বিষয়ে জেনে বিতর্ক করার চেষ্টা করে এবং ঘুরেফিরে একই বিষয় ব্যবহার করার চিন্তা করে। অথচ বিজ্ঞান কী, কেন প্রয়োজন, দর্শনকে কীভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, শিক্ষানীতিতে কীভাবে একীভূত করা হয়েছে, বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি বিষয় বিতার্কিকেরা জানে না।

বর্তমান সময়ের বিতার্কিকেরা জানার চেয়ে উপস্থাপনকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এমন বিতার্কিকদের জন্য একটাই কথা, তোমরা বৈজ্ঞানিক, চিন্তাশীল বা যুক্তিবাদী মানুষ হতে না চেয়ে টেলিভিশনের উপস্থাপক হওয়ার চেষ্টা করো। কারণ, বিতর্ক এমন এক শিল্প, যখন কেউ বিতর্ক করবে, তখন তার বিতর্ক শোনার জন্য মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়বে, যদি সে সহজ ভাষা ও কঠিন বিষয়কে সহজ করে উপস্থাপনের মাধ্যমে তা করে। বিতর্ক শেষে সেই কথাগুলো নিয়ে আলোচনা হবে, কথাগুলোর মানে খোঁজার চেষ্টা হবে। স্টেজ থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে সেই বিষয়গুলো নিয়ে বিতার্কিকের সঙ্গে আলোচনা করবে, রেফারেন্স বা তথ্যসূত্র চাইবে। বিতার্কিককে অন্যরা অনুসরণ করার চেষ্টা করবে, নায়ক ভাববে। অর্থাৎ একজন বিতার্কিকের কোনো বিষয়ে শুধু জানা নয় বরং একটু গভীর করে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা থাকতে হবে। তাকে একজন গভীর বিশ্লেষকও হতে হবে। যুক্তিপূর্ণ ও চিন্তাশীল বিতর্ক করার জন্য পড়ালেখা ও জানার কোনো বিকল্প নেই। যেকোনো বিষয়ে ভালো জ্ঞান থাকলে খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তার পক্ষে বা বিপক্ষে যুক্তি দেওয়া যায়। অথচ সেদিকে আমাদের নজর কম। বিতর্কের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে রুশ মনোবিজ্ঞানী তিমিয়ারিজবের বিখ্যাত উক্তি—‘এ লার্নেড ম্যান ইজ হি হু নোজ সামথিং অব এভরিথিং অ্যান্ড এভরিথিং অব সামথিং।’ এখানে কিছু জানা বলতে নিশ্চয়ই তিনি কারও মুখে দু–এক লাইন শুনে বিতর্কের মঞ্চে দাঁড়ানোকে বোঝাননি। এখনকার বিতার্কিকেরা বিতর্কের মঞ্চে দাঁড়ানোর আগে ফোনে কিছু শুনে ঝেড়ে আসার চেষ্টা করে, বোঝা যায় যে তারা বিষয়টি নিয়ে পড়েনি, তাই প্রয়োজনে কতটুকু ব্যবহার করবে, তা বলতে পারে না।

একজন বির্তার্কিক যে বিষয়েই পড়ুক না কেন, তার সমসাময়িক সব বিষয়ে জ্ঞান থাকা জরুরি। যেমন অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, পুঁজিবাদ, বিশ্বায়ন, সমসাময়িক রাজনীতি, বৈশ্বিক পরিবর্তন, তথ্যপ্রযুক্তি, সোশ্যাল মিডিয়া, পরিবেশ, শিক্ষা, উন্নয়ন, মানবিকতাবোধ ও এর পরিবর্তন, সংস্কৃতি ও তার পরিবর্তন ইত্যাদি। এসব বিষয়ে জানতে হলে একাডেমিক পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন জার্নাল, বই, ইন্টারনেট, টেলিভিশন, পত্রিকা, রেডিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এসব বিষয়ে জানার জন্য বাজারে বিভিন্ন লেখকের সহজ ভাষায় অনেক বই পাওয়া যায়। যেমন অর্থনীতি নিয়ে যদি খুব সাধারণ বা বেসিক বিষয়ে জানতে চাই, তাহলে বাজারে ‘ছোটদের অর্থনীতি’ নামে বই পাওয়া যাবে। পড়লে অর্থনীতি বিষয়টি খুব সহজে জানা যাবে।

বিশ্বায়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্বায়নসংক্রান্ত খুব গভীর আলোচনা ও একেবারে বেসিক আলোচনার বই পাওয়া যায়। খুব সহজে জানতে চাইলে প্রথমেই সাধারণ ও সহজ উদাহরণ দেওয়া আছে, তা পড়া উচিত। এরপরও জানার আগ্রহ হলে বিষয়ের গভীরতা–সমৃদ্ধ বই পড়া যেতে পারে। এ ধরনের বই নীলক্ষেত বা আজিজ সুপার মার্কেটে পাওয়া যায়। এ ছাড়া ইন্টারনেট থেকে খুব সহজে জানতে পারা যায়। ঠিক একইভাবে ইন্টারনেট থেকে যেকোনো বিষয়ে সহজ ও কঠিন আলোচনা পাওয়া যায় ইন্টারনেট ও পত্রিকায়। যেকোনো বিষয়ে গভীর করে জানার উৎস হলো বই ও ইন্টারনেট।

কোনো একটি বিষয় হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভাবতে হবে কীভাবে ও কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টি উপস্থাপন করব। এরপর ভাবতে হবে যুক্তির প্রয়োজন কোন বিষয়গুলোকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এরপর তিনজন মিলে ভাগ করে নিতে হবে কে কতটুকু বলবে। ধরা যাক বিতর্কের বিষয় ‘দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অঙ্গীকার’। এখানে প্রথমেই ভাবতে হবে দারিদ্র্য কী, মুক্তিযুদ্ধ বলতে কী বোঝাব, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কী বলব, অঙ্গীকার বলতে কী বলব? আবার যদি বিরোধী হয় তাহলে চিন্তা করতে হবে দারিদ্র্যমুক্ত না হলে কী–মুক্ত বাংলাদেশ তারা চাইবে। এরপর প্রথম, দ্বিতীয় ও দলনেতা মিলে ভাগ করে নিতে হবে কে কী বলবে।

একজন বিতার্কিকের জানা প্রয়োজন কী বলব–এর চেয়েও বেশি জরুরি কীভাবে বলব এবং কেন বলব? কতটুকু বললে আমার লাভ হবে, ঠিক ততটুকুই বলব। ঠিক একইভাবে বিতর্কের জন্য প্রস্তুতিও খুব গুরুত্বপূর্ণ; তা হলো কী জানব, কোথা থেকে জানব, কার কাছে জানব, কেন জানব ইত্যাদি। আমি জানি, বিতর্কের ক্ষেত্রে আমি যে কথাগুলো বললাম, তা অনেকেই খেয়াল করে না। কারণ, হাততালি বা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য পরিশ্রমের প্রয়োজন নেই, শুধু উপস্থাপন কৌশল ও খুব সামান্য জ্ঞান থাকলেই জিতে যাওয়া যায়, যা অনেকেই বিশ্বাস করে। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে একজন বিশ্বনাগরিক হওয়ার জন্য এবং সত্যিকারের জ্ঞানসম্পন্ন, যুক্তিবাদী ও চিন্তাশীল বিতার্কিক হওয়ার জন্য পড়ালেখার কোনো বিকল্প নেই।

যুক্তি তখনই সুন্দর ও সার্থক হবে, যখন সেখানে জ্ঞান থাকবে। আর জ্ঞানের পূর্বশর্ত হলো পড়ালেখা করা। কারণ, একজন বিতার্কিকের সমসাময়িক সব বিষয়ে জ্ঞান থাকা জরুরি। সেদিন আর বেশি দিন দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশে সুন্দর উপস্থাপনের চেয়ে জ্ঞান ও অধিক যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যই অধিক গুরুত্ব পাবে। আশা করি বর্তমান সময়ের বিতার্কিক সেদিকে এগিয়ে যাবে। কারণ, এখন বাংলাদেশে সুন্দর করে কথা বলা লোকের সংখ্যা অনেক, কিন্তু সুন্দর করে চিন্তা করা, জ্ঞানী ও সব বিষয়ে জানাশোনা লোকের সংখ্যা খুবই কম। আশা করি, বর্তমান সময়ের বিতার্কিকেরা সেই দায়িত্ব নেবে। এই প্রত্যাশাই করি।

লেখক: সভাপতি, প্রথম আলো ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা।
১৮তম জাতীয় টেলিভিশন বিতর্কে চ্যাম্পিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক দলের সদস্য ও দলনেতা হিসেবে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন।

(লেখাটি প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের প্রকাশনা ‘তারুণ্য’–এর অষ্টম সংখ্যা (ফেব্রুয়ারি ২০১৯) থেকে নেওয়া।)

বন্ধুসভায় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]