যুদ্ধপীড়িত দক্ষিণ সুদানে জাতিসংঘ স্টাফ ডে উদ্যাপন

দক্ষিণ সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা
দক্ষিণ সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা

জাতিসংঘ স্টাফ ডে পালন শুরু হয় ১৯৫৩ সাল থেকে। এই দিবসটি পালন করা হয় বিশ্বজুড়ে মানবিক সাহায্য, জরুরি খাদ্য সহায়তা, মানবাধিকার ও শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত জাতিসংঘের কর্মীদের ত্যাগ, পরিশ্রম ও কর্তব্য নিষ্ঠাকে স্মরণ করে। জাতিসংঘের ৭১ বছরের ইতিহাসে সাড়ে তিন হাজারের বেশি কর্মী এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন। প্রতি বছর ২৫ অক্টোবর তাঁদের ত্যাগ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন যুদ্ধপীড়িত দেশে নিয়োজিত ১ লাখ ৭ হাজারেরও বেশি শান্তিরক্ষীদের এই দিবসটির মাধ্যমে সম্মান জানানো হয়।

বক্তব্য দিচ্ছেন ডেবোরাহ শেইন
বক্তব্য দিচ্ছেন ডেবোরাহ শেইন

দক্ষিণ সুদান জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশ থেকে বর্তমানে ২৩ জন কর্মকর্তা পুলিশ অ্যাডভাইজার হিসেবে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে বিভিন্ন দায়িত্বে কর্মরত আছেন।
দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ২০১১ সালের ৯ জুলাই সুদান থেকে স্বাধীনতা লাভ করে পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্র দক্ষিণ সুদান। দেশটির রাজধানী জুবা। সুদান, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা, কঙ্গো ও মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র দক্ষিণ সুদানের প্রতিবেশী দেশ। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরও দেশটিতে শান্তি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট সালভা কির ও তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. রিয়েক মাচারের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সালভা কির ডিঙ্কা গোত্রের। রিয়েক মাচার নুয়ের গোত্রের। প্রেনিডেন্ট সালভা কির ভাইস প্রেসিডেন্ট রিয়েক মাচারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনেন। এরপর তাদের উভয়ের অনুগতদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এই রক্তক্ষয়ী, ভয়াবহ ও নৃশংস গোত্র সংঘাত। প্রতিবেশী দেশ উগান্ডা সালভা কিরের সমর্থনে তাদের সেনাবাহিনী পাঠায়। এই সংঘাতে ২১ জন উগান্ডান সেনা, ৫ জন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী সদস্যসহ দক্ষিণ সুদানের প্রায় ৩ লাখ লোক মারা যায়। ১০ লাখ লোক ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে পড়েন এবং ৪ লাখ লোক পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে পালিয়ে যান। শুরু হয় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়।

শিশুদের পরিবেশনা
শিশুদের পরিবেশনা

২০১৫ সালের আগস্ট মাসে আন্তর্জাতিক চাপ ও মধ্যস্থতায় প্রতিবেশী দেশ ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় উভয় পক্ষের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই মধ্যস্থতায় আফ্রিকান ইউনিয়ন, জাতিসংঘ, চীন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও নরওয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের মার্চ মাসে ভাইস প্রেসিডেন্ট রিয়েক মাচার দেশে ফিরে আসেন শান্তির আশা জাগিয়ে। কিন্তু জুলাই ২০১৬ সালে আবার তাঁর দেহরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে সালভা কিরের অনুগত বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে ৩০০ লোকের প্রাণহানি হয়। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর ২ জন চীনা সেনাও এই সংঘাতে নিহত হন। নতুনভাবে বহু লোক ঘর বাড়ি হারায় ও উদ্বাস্তু হয়ে যায়। ভাইস প্রেসিডেন্ট রিয়েক মাচার তাঁর অনুসারীসহ দেশ থেকে পার্শ্ববর্তী দেশ কঙ্গোয় পালিয়ে যান। সেখান থেকে তিনি সুদান যান এবং প্রেসিডেন্ট সালভা কিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

শিশুদের সঙ্গে লেখক
শিশুদের সঙ্গে লেখক

নতুনভাবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর শঙ্কাপূর্ণ পরিবেশের মধ্যেই গত ২৫ অক্টোবর দক্ষিণ সুদান জাতিসংঘ মিশন (United Nations Mission in South Sudan, UNMISS) জাতিসংঘ স্টাফ ডে উদ্‌যাপন করেছে। অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় বোর ইউএন বেজ ক্যাম্পের অনতিদূরে জন গারাং মেমোরিয়াল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। এ উপলক্ষে যুদ্ধপীড়িত বোর শহরজুড়ে এক আনন্দঘন ও উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এই উৎসবে জাতিসংঘ মিশনের সেনা, পুলিশ ও বেসামরিক স্টাফসহ অন্যান্য সংস্থার কর্মীরাও অংশ নেন। এ ছাড়া এই অনুষ্ঠানে বোর শহরের পদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা ছাড়াও স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় বিভিন্ন গোত্রের জনগণও অংশ নেন। এ কারণে অনুষ্ঠানটি হয়ে ওঠে বর্ণিল ও মনোমুগ্ধকর।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন দক্ষিণ সুদান ইউএন মিশনের বোর ফিল্ড অফিস প্রধান মিসেস ডেবোরাহ শেইন। তিনি মার্কিন নাগরিক ও ইতিপূর্বে বিভিন্ন ইউএন মিশনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর স্বাগত বক্তব্যের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়।

স্থানীয় তরুণ তরুণীদের ঐতিহ্যবাহী উপজাতীয় নাচ
স্থানীয় তরুণ তরুণীদের ঐতিহ্যবাহী উপজাতীয় নাচ

স্থানীয় একটি স্কুলের শিশুরা পরিবেশনা শুরু করে শান্তির আকুতি জানিয়ে। তারা নিজেদের বলছিল চিলড্রেন অব ওয়ার। গানে গানে তারা বলছিল আজন্ম তারা যুদ্ধের মধ্যে বেড়ে উঠেছে। তাদের ঘর নেই, উদ্বাস্তু জীবন, খাবার নেই, বিশুদ্ধ পানি নেই, স্কুল নেই। বেশির ভাগ সেনাদের দখলে। যুদ্ধ, মৃত্যু, রোগ, অনাহার তাদের নিত্যসঙ্গী। তারা শান্তি চায়, তারা বাঁচতে চায়। স্কুল শিশুদের পরিবেশনা সবার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। অনেকেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। এরপর স্থানীয় জন গারাং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নাটক পরিবেশন করে। এর মাধ্যমে তারা তুলে ধরে কীভাবে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ জোরপূর্বক স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের অপহরণের পর অস্ত্র তুলে দিয়ে যুদ্ধ করতে বাধ্য করে। এরপর স্থানীয় তরুণ তরুণীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী দলীয় উপজাতীয় নাচ পরিবেশন করে। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষীদের মধ্য থেকে কোরীয় শান্তিরক্ষীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী ড্রাম বাদন ও চোখ ধাঁধানো সামরিক কুচকাওয়াজ পরিবেশন করে। ইথিওপিয়ার শান্তিরক্ষীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী গান ও নাচ পরিবেশন করে। অনুষ্ঠানের বড় আকর্ষণ ছিল স্থানীয় তরুণদের ঐতিহ্যবাহী কুস্তি প্রতিযোগিতা।

কোরীয় শান্তিরক্ষীদের পরিবেশনা
কোরীয় শান্তিরক্ষীদের পরিবেশনা

এদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য হলেও স্থানীয় অধিবাসী, ঘরবাড়ি হারানো উদ্বাস্তু ও স্বজন হারানো লোকজন সব দুঃখ শঙ্কা ভুলে আনন্দে মেতে উঠেছিল। অনুষ্ঠানের মূল বার্তাই ছিল যুদ্ধ নয় শান্তি। সবার অন্তরে ছড়িয়ে পড়ুক এই বার্তা, শান্তি আসুক এই দেশে।

ইথিওপিয়ার শান্তিরক্ষীদের পরিবেশনা
ইথিওপিয়ার শান্তিরক্ষীদের পরিবেশনা