গা ছমছমে যে অনুভূতি সারা জীবন মনে থাকবে

লচলোমন্ড
লচলোমন্ড

আটলান্টিক মহাসাগর বেষ্টিত স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্যের সর্ব উত্তরে অবস্থিত। এর রাজধানী এডিনবার্গ এবং আরও একটি বড় শহর গ্লাসগো, যার অন্যতম পরিচয় বিশ্বখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি।

স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে নির্মিত অস্কারজয়ী সিনেমা ব্রেভহার্ট দেখার পর হতেই স্কটল্যান্ড বা স্কটিশদের প্রতি আমি বরাবরই অনুভূতিশীল। আর আমাদের সবারই জানা আছে, জগৎ বিখ্যাত কল্পকাহিনি হ্যারি পটারের জন্মই হয়েছে স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গের কফিশপ দ্য এলিফ্যান্ট হাউসের টেবিলে। অর্থাৎ জে কে রাউলিং এই কফিশপে বসেই হ্যারি পটার সিরিজের প্রথম গল্প হ্যারি পটার অ্যান্ড ফিলোসফার স্টোন রচনা করেছিলেন। বর্তমানেও তিনি স্কটল্যান্ডে বাস করেন।
হ্যারি পটার সিরিজ চলচ্চিত্রের চিত্রায়ণে স্কটল্যান্ড বিশেষ করে স্কটিশ হাইল্যান্ডের মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখে স্কটল্যান্ড ভ্রমণের স্বপ্ন দেখেছি। পরবর্তীতে লন্ডনের প্রবাসজীবনে স্কটিশ স্বাধীনতা-গণভোটের ফলাফল দেখা ও সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির ৫৬ জন সদস্য এবং যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে স্কটল্যান্ড থেকে সর্বকনিষ্ঠ এমপি মারাই ব্ল্যাকের (মাত্র ২০ বছর) নির্বাচিত হওয়া; অর্থাৎ সবকিছু মিলিয়ে স্কটল্যান্ডের প্রতি আমার আগ্রহ সীমাহীন। তাই প্রতিবছর এ দেশের সামার তথা গ্রীষ্মকালে স্কটল্যান্ড ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছি। কিন্তু সুযোগ হয়নি। সৌভাগ্যক্রমে এবার স্কটল্যান্ড ভ্রমণের সুযোগও চলে আসে।

ব্রিজ অব আর্চ
ব্রিজ অব আর্চ

আমার লন্ডনের বাসস্থান থেকে গাড়িযোগে স্কটল্যান্ডে যাত্রা সময় প্রায় ৭ ঘণ্টা। দেশ থেকে এক আত্মীয় স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ইউনির্ভাসিটিতে উচ্চশিক্ষার্থে এসেছেন, তার সঙ্গে দেখা করতে কোনো এক সাপ্তাহিক ছুটির দিন ধরে স্কটল্যান্ড যাত্রা করি। তখন এখানে ফল চলছে। যুক্তরাজ্যে গ্রীষ্মকাল শেষে শীতের আগমনী সময়কে স্থানীয়ভাবে ফল বলা হয়। এ সময় শুরু হয় প্রকৃতির রূপ বদলের পালা। শীতকে বরণ করার জন্য প্রকৃতি তখন বর্ণিল। পাতা ঝরার দিন শুরু। এ জন্য সবুজ গাছগুলো ক্রমেই হলুদ, কমলা, লাল এবং বাদামি বর্ণ ধারণ করছে। প্রকৃতির এই রূপান্তরের সৌন্দর্য অপার্থিব। রাস্তার দুই পাশে লাল-কমলা আর হলুদ-সবুজের দুর্দান্ত কম্বিনেশনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকনে ৭ ঘণ্টা যেন খুব সহসাই কেটে যায়। পূর্বেই বুক করে রাখা হোটেলে রাত্রিযাপন করে সকালেই বেরিয়ে পড়ি। গ্লাসগো ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট ডরমিটরি থেকে আত্মীয়কে নিয়ে আমরা তিনজন, গন্তব্য প্রাথমিকভাবে লচলোমন্ড ও স্কটিশ হাইল্যান্ড।গ্লাসগো থেকে বের হয়ে রাস্তার বামে গাড়ি বাঁক নিতেই দেখা মেলে এক সরু পাহাড়ি ঝরনা, বর্ণিল গাছ-গাছালি ও বাদামি ঝোপ। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে এত সুন্দর একটি স্থান দেখে যথারীতি বিস্মিত হই। গুগল দেখে জানতে পারি এর নাম আলেকজান্দ্রিয়া। এরপর যাই স্কটল্যান্ডের অন্যতম আকর্ষণ লচলোমন্ডে। উল্লেখ্য, স্কটিশ ভাষায় লচলোমন্ড মানে বিশুদ্ধ পানি। পাহাড় বেষ্টিত এই লচলোমন্ড যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক জলাধারসমৃদ্ধ দ্বীপ। পাহাড়, নির্মল জলাধার এবং এর চারপাশ ঘিরে থাকা রঙিন গাছপালাপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশ লেখায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। স্কটল্যান্ড মূলত পাহাড়, পাহাড়ের বুক চিরে বেয়ে চলা ঝরনা, প্রাকৃতিক জলাধার বা লেকে পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের লীলাভূমি। তাই এখানে অনেক লচের ছড়াছড়ি, যেমন লচআবার, লচসেইল, লচইলিট, লচইটিভ ইত্যাদি। লচলোমন্ডের মুগ্ধতার রেশ না কাটতেই চলে গেলাম ডামবার্টন হাইওয়ে ধরে কার্ডরোজ গার্ডেনে। কার্ডরোজ স্কটল্যান্ডের একটি গ্রাম, এখানে গড়ে ওঠা এই গার্ডেনের নিরিবিলি পরিবেশ, পাখির কলতান, রঙিন ফুল ও গাছের সমারোহ মনকে সতেজ ও প্রশান্ত করে দেয়। তা ছাড়া বাগানের অভ্যন্তরে সরু কিন্তু মধুর স্বরে বয়ে যাওয়া ঝরনার স্মৃতি ভুলে যাওয়ার মতো নয়।

কিলিংয়ের ঝরনা
কিলিংয়ের ঝরনা

তারপর মোটরওয়ে ধরে স্কটিশ হাইল্যান্ডের দিকে ছুটে চলা; কিন্তু এ ছুটে চলাও বিরতিহীন ছিল না। পথের দুই ধারের পাহাড়; পাহাড়ের পাদদেশে ছবির মতো সাজানো বাড়ি কিংবা প্রাকৃতিক ঝরনার আওয়াজে যাত্রাবিরতি না করে উপায়ও ছিল না। তাই এসব স্থান দেখে, ছবি তুলে আবারও ছুটে চলা। এর মাঝে ব্রিজ অব আর্চ; জায়গাটি এতই সুন্দর যে, ছুটে চলা প্রতিটি গাড়ি এখানে থেমেছে, যাত্রীরা নীরবে দাঁড়িয়ে বা বসে এখানকার পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে রঙিন মেঘের খেলা এবং লেকের সৌন্দর্য অবলোকন করেছেন। সত্যি, প্রকৃতির এই রূপ নিস্তব্ধ ও নির্বাক করে দেয়। মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতির এই বিশালতা ও বৈভবের সামনে আমাদের উপস্থিতি, সাজসজ্জা কত তুচ্ছ ও মলিন। এরই মাঝে আমার সঙ্গী এই বর্ণিল অথচ শান্ত-নিস্তব্ধ নিসর্গ ছুঁয়ে দেখার জন্য দে-ছুট। কিন্তু এ অপার্থিব সৌন্দর্যতো মায়াবন বিহারিণী, একে ধরা যায় না, শুধু উপভোগ করা যায়। ব্রিজ অব আর্চ থেকে আবারও হাইওয়ে ধরে ছুটে চলা। চারপাশে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত পাহাড় আর পাহাড়; আর এটাই স্কটিশ হাইল্যান্ড। এ স্থানের নাম গ্লেনকো। এটি স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর ও সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান হিসেবে পরিচিত। এই গ্লেনকোর পূর্ব প্রান্তে রয়েছে কিং হাউস হোটেল। জনবিচ্ছিন্ন ও পাহাড়বেষ্টিত স্থানে এই হোটেল নির্মিত হয় ১৭ শতকে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে এর আধুনিকায়ন হয়েছে। এই হোটেল মূলত পর্বতারোহীদের আবাসস্থল।
এবার ফেরার পালা। কারণ বিকেলও প্রায় শেষের পথে। যথারীতি পথের সঙ্গী দুই পাশের পাহাড় আর মাঝে বয়ে চলা জলরাশি। এসব লেকের পাশে প্রায়শই চোখে পড়েছে সারি সারি ক্যারাভ্যান ও বিভিন্ন ক্যাম্পিং সাইট। সাইনবোর্ডে লেখা শোভা পাচ্ছে প্রতি রাতযাপন ব্যক্তিপ্রতি মাত্র ২০ পাউন্ড। ভাবছিলাম যেকোনো তারকা হোটেলে ইট-সিমেন্টের গাঁথুনি আর কৃত্রিম সুইমিংপুলে গা-ভেজানোর জন্য হাজার পাউন্ড খরচে রাত্রি যাপনের চেয়ে প্রকৃতিতে নিবিড় হওয়ার সুযোগ এখনো অনেক সাশ্রয়ী।

বেন লেয়ার্সের গাড়ির রাস্তা ও পাসিং প্লেস
বেন লেয়ার্সের গাড়ির রাস্তা ও পাসিং প্লেস

গ্লেনকো থেকে ফেরার পথে আচমকাই দেখা মেলে আরও একটি ঝরনা; নাম কিলিং। সারা দিনে আমাদের দেখা ৫-৬টি ঝরনার মাঝে এটিই সবচেয়ে বড় এবং অপেক্ষাকৃত অনেক স্থান বিস্তৃত। তাই বড় বড় পাথরের মাঝ দিয়ে তুমুল গর্জনে বয়ে চলা এর জলরাশির ঝাপটা পেতে খুব বেশি কাছে যেতে হয়নি। কিলিং থেকে পূর্বদিকে ৩-৪ মাইল যেতেই বেন লেয়ার্স পর্বত। সাইনবোর্ডে লেখা সর্বোচ্চ পর্বত, উচ্চতা ৪০০০ ফিট এবং ওপরে উঠার জন্য গাড়ির রাস্তা রয়েছে। সুতরাং অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য এ এক সুবর্ণ সুযোগ; তাই আমরাও শেষ বিকেলের আলোয় বেন লেয়ার্সে উঠতে থাকি। এই পর্বতের একপাশে সরু রাস্তা করা হয়েছে, নিচে যথারীতি গভীর খাদ ও পানি। এ রাস্তা দিয়ে একটি গাড়িই চলতে পারে, স্থানে স্থানে সামান্য জায়গা করা পাসিং প্লেস বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়িদের অতিক্রম করার সুযোগ দেয়। কিন্তু প্রায় আধা ঘণ্টা চলার পর শুরু হয় এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। কারণ ইতিমধ্যে সূর্য অস্ত গিয়েছে, গাড়ির হেডলাইটের আলো ছাড়া চারপাশ অন্ধকার, পথ প্রদর্শনকারী নেভিগেশনও অচল। সুতরাং ফিরে আসার উপায় নেই। তাই এ পথেই চলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তারপর প্রায় দুই ঘণ্টা চলার পর পাহাড় অতিক্রম করে স্বাভাবিক ও ফেরার রাস্তায় পৌঁছানো। কিন্তু গা ছমছমে এই দুই ঘণ্টার অনুভূতি সারা জীবন মনে থাকবে। পাহাড়ে চড়ার সময় দিনের আলোতে এর উচ্চতা, নিচের গভীরতা দেখতে পেরেছিলাম। তাই যারা পাহাড় কেটে পর্বতারোহী এবং পর্যটকদের জন্য পায়ে ও গাড়িতে চলার এই পথের পরিকল্পনা ও তৈরি করেছেন, তাদের মেধা ও শ্রমের কথা ভেবে একই সঙ্গে আশ্চর্য ও শ্রদ্ধায় অবনত হই।
স্কটিশ হাইল্যান্ড গ্রীষ্ম বা শীত উভয় সময়ই পর্বতারোহীদের জন্য স্বর্গরাজ্য। আমরাও পেছনে ব্যাগ, পায়ে ভারী জুতো আর হাতে পাহাড়ে ওঠার ষ্টিকসহ দল বেধে চলা অনেক পর্বতারোহীদের দেখা পেয়েছি। আর শীতকালে পাহাড়গুলো বরফে আচ্ছাদিত থাকায় এটি স্কির জন্য আদর্শ স্থান। উল্লেখ্য স্কটল্যান্ডের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রানি ভিক্টোরিয়ার স্বামী প্রিন্স আলবার্ট ১৮৫২ সনে বালমোরাল ক্যাসল কিনেছিলেন। রানি ভিক্টোরিয়া তার রাজত্বকালে গ্রীষ্মকালীন সময় এই ক্যাসেলেই কাটাতেন। এখনো এই ক্যাসেল রানি এলিজাবেথের অবকাশযাপন কেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত।

পাহাড়ের পাদদেশে সাজানো বাড়ি
পাহাড়ের পাদদেশে সাজানো বাড়ি

প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে আমাদের বর্তমান জীবনযাত্রা যেমনি সহজ তেমনি অসুখীও বটে। এখন আমাদের সবকিছুতেই তাড়াহুড়া, অস্বস্তি আর অযথা দুশ্চিন্তা; আর এগুলোর মূলে রয়েছে মোবাইলের চার্জ নেই, দুর্বল নেটওয়ার্ক কিংবা ওয়াইফাইয়ের পাসওয়ার্ড কাজ করছে না ইত্যাদি। কিন্তু এর বাইরেও জীবন আছে, জীবনের মানে খুঁজে নেবার উপায় আছে। আর এ জন্য আমাদের প্রকৃতির কাছেই ফিরে যেতে হবে। প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকা মানুষগুলো এ জন্যই এখনো অনেক সহজ, স্বাভাবিক ও আন্তরিক। সারা দিনে স্কটল্যান্ডের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণে পথ, দোকান বা রেস্তোরাঁয় যাদের সঙ্গেই কথা হয়েছে বা পরিচয় হয়েছে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত ও আন্তরিকতাপূর্ণ সম্ভাষণ এবং ব্যবহারের প্রশংসা না করে পারা যায় না। সবুজ, রঙিন ও ধূসর গাছ-গাছালি, ঝরনার শব্দ, নদীর প্রবাহ, সমুদ্রের গর্জন, সূর্যের প্রখরতা কিংবা চাঁদের কোমলতা এগুলো শুধুই প্রকৃতির রূপ বৈচিত্র্য নয়। এর সঙ্গে মানব জীবনের বিভিন্ন পর্যায়, সময় এবং মুহূর্তের যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে; অন্তত আমি প্রকৃতি ভ্রমণে এর নিবিড় সান্নিধ্যে জীবনের সাদৃশ্য খুঁজে নিতে চেষ্টা করি এবং পেয়েও যাই। আমাদের মনে রাখা উচিত, প্রকৃতির আমাদের প্রয়োজন নেই, আমাদেরই নিজেদের একঘেয়ে-কর্মব্যস্ত জীবনে খানিকটা ছুটি ও স্বস্তি এবং মানসিক প্রশান্তির জন্য প্রকৃতির কাছেই যেতে হবে। স্কটল্যান্ড ভ্রমণ ও এর অপার্থিব সৌন্দর্য অবলোকনের এই সব অনুভূতিগুলোই মনে রেখে দিলাম।

*রাজিয়া সুলতানা, ব্যারিস্টার, রেডব্রিজ, লন্ডন, যুক্তরাজ্য।