বাংলাদেশি ঝাল খাবার আর একজন ইতালিয়ান

ইতালিয়ান বন্ধুর সঙ্গে লেখক
ইতালিয়ান বন্ধুর সঙ্গে লেখক

আমি তখন Erasmus Mundus Scholarship নিয়ে অস্ট্রিয়াতে থাকি। ক্লাগেনফারট নামে ছবির মতো সুন্দর একটা ছোট শহরে ক্লাগেনফারট বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছি। ওটা ছিল আমার প্রাইমারি বিশ্ববিদ্যালয়। আমার সেকেন্ডারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ইতালির জেনোভা বিশ্ববিদ্যালয়।

Erasmus Mundus PhD Scholarship in Interactive and Cognitive Environment-এর প্রায় সাড়ে ছয় শ আবেদন থেকে বাছাই করা দশজনের মধ্যে আমি ছিলাম বাংলাদেশ থেকে আসা একমাত্র শিক্ষার্থী। বাকিরা ছিলেন কানাডা, রাশিয়া, ইতালি, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, চীন, কলম্বিয়া আর ক্রোয়েশিয়ার শিক্ষার্থী। আমাদের বিভিন্নজনকে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হলো। ক্লাগেনফারটে এলাম আমি, কানাডা আর ইতালির শিক্ষার্থী।
ইতালির শিক্ষার্থী আর আমাকে একই রুমে বসতে দেওয়া হলো। দ্রুত আমরা একজন আরেকজনের ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম। আমার বাসায় দুবার দাওয়াতও খাওয়া হয়ে গেল তাঁর। আমার সহধর্মিণী তাঁর জন্য সব সময় বিদেশি আইটেম রান্না করত। তাঁর দাওয়াত খাবার শর্ত ছিল, খাবারে একদম ঝাল দেওয়া যাবে না। রান্নার সময় এই বিষয়টা আমরা মাথায় রাখতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার ইতালির বন্ধুর ভেতরের ইউরোপিয়ান নাক উঁচু ভাবটা বের হয়ে আসতে শুরু করল।
আমি বাসা থেকে খাবার নিয়ে যেতাম লাঞ্চের জন্য। বেশির ভাগ সময় ভাত ও ঝালযুক্ত রান্না করা তরকারী নিয়ে যেতাম। আমরা আমাদের অফিস রুমেই লাঞ্চ করতাম। একদিন আমি আমার টিফিন বাটি খুলে খাওয়া শুরু করেছি। সেদিন সহধর্মিণী দিয়েছিলেন মাছ আর ভাত। খাওয়া শুরু করেছি। আচমকা দেখি আমার ইতালিয়ান বন্ধু সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বলা শুরু করলেন, এসব খাবার আমার সামনে খাবে না। ঝাল খাবারের গন্ধে আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আর তোমার শরীর থেকে পরে এই সব গন্ধ আসে।
আমি তো তাঁর কথা শুনে অবাক। চার মাসের ওপরে একসঙ্গে খাবার পর সে এটা বলে কী। আমি বললাম, তোমার অনেক খাবারেও তো আমি গন্ধ পাই। সেটা তো আমি তোমাকে বলি না।
ই​তালিয়ান বন্ধু কিছু শুনতে চাইছিলেন না। ইতালিয়ান উচ্চারণে ইংরেজিতে বলতে থাকলেন, আমি যদি আবার এখানে খাই তাহলে সে রুম পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে। অবস্থা বেগতিক দেখে আমি পরের দিন থেকে লাঞ্চ রুমে খাওয়া শুরু করলাম।
ঘটনাটা এখানেই মিটে যেতে পারত। কিন্তু ওই ইতালিয়ান আমার প্রফেসরের কাছে নালিশ দিয়ে বসলেন। এবার আর আমার ব্যাপারটা সহ্য হলো না। আমার বাঙালি সত্তা জেগে উঠল। আমি আমার প্রফেসরের কাছে ওর নামে Racism-এর অভিযোগ তুললাম। ইউরোপে এটা খুব মারাত্মক ইস্যু। আমার প্রফেসর বললেন, যে লোক তোমার বাসায় দুবার খেয়ে আসে সে কীভাবে এসব গন্ধ ইস্যু তোলে।
এরপর পরিস্থিতি উলটে গেল। ইতালিয়ান Racism-এর দায়ে অভিযুক্ত। প্রফেসরেরা আমার কাছে তাঁকে ক্ষমা চাইতে বললেন। পরদিন অফিস ছুটি হলে আমার কাছে এসে ই​তালিয়ান বন্ধু বললেন, আমি ক্ষমা প্রার্থী। সেদিন আমার মন মেজাজ ভালো ছিল না। তিনি আবারও বললেন, আমি সত্যিই দুঃখিত। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। এমনভাবে বললেন, আমি ক্ষমা করে দিলাম।
ওই দিন থেকে ইতালিয়ান ভিন্ন মানুষ হয়ে গেল। প্রথমবারের মতো আমাকে আর আমার সহধর্মিণীকে তাঁর বাসায় দাওয়াত দিল। গিয়ে দেখি আমাদের জন্য তিনি পিৎজা বানাচ্ছেন। আমাদেরও ময়দা ছানতে বললেন। আমরা তো অবাক। এ রকম খুঁতখুঁতে লোক এখন আমাদের ময়দা ছানতে বলছে। আমরা খুশি মনে ময়দাতে হাত দিলাম। রান্না শেষে সবাই মজা করে পিৎজা খেলাম। এরপর থেকে আমরা দুজন অনেক কাছের বন্ধু। এখনো অনলাইনে চ্যাট করতে বসলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় এই বাঙালি ঝাল খাবারই আমাদের এত সুন্দর বন্ধুত্ব উপহার দিয়েছে। জয় হোক বাংলাদেশি ঝাল খাবারের।

লেখক পোস্ট ডক্টরাল ফেলো, হেবেই ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, তিয়াঞ্জিন, চীন।