নেদারল্যান্ডসের ওয়াখেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের মতবিনিময়

মতবিনিময়ের দৃশ্য
মতবিনিময়ের দৃশ্য

জানুয়ারি মাসের তীব্র শীতকে অগ্রাহ্য করে নেদারল্যান্ডসের ওয়াখেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনা ত্রিশ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী গত মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় একত্রিত হয়েছিলেন ক্যাম্পাসের পাশে এক রেস্তোরাঁয়। আলাপ-আলোচনা আর তারুণ্যের উষ্ণতায় বিদেশ-বিভুঁইয়ের একটি শীতল সন্ধ্যাকে তারা একান্ত আপন করে তুলেছিলেন। উৎসাহী নারী শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ ভোলেননি তাদের সংগ্রহের সেরা শাড়িটি গায়ে চড়াতে। সেদিনের সন্ধ্যাতো কেবল তাদের, কেবল তার মতো বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের। আর তারা সেখানে সমবেত হয়েছিলেন নেদারল্যান্ডসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ মুহম্মদ বেলালের আমন্ত্রণে।

কৃষিপ্রযুক্তিতে বিশ্বের অন্যতম সেরা নেদারল্যান্ডসের কৃষি গবেষণা ও উদ্ভাবনের পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত ওয়াখেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পছন্দের গন্তব্যগুলোর একটি। বাংলাদেশের বিভিন্ন কৃষি শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতি বছর উচ্চশিক্ষার্থে বেছে নেন এই বিশ্ববিদ্যালয়কে। মাস্টার্স-পিএইচডি ইত্যাদি মিলে বছরব্যাপী অন্তত ত্রিশ থেকে চল্লিশজন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী থাকেন সবুজ, সুবিশাল ওয়াখেনিংগেন ক্যাম্পাসে।

শেখ মুহম্মদ বেলাল ও তার সহধর্মিণীকে স্মারক উপহার দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা
শেখ মুহম্মদ বেলাল ও তার সহধর্মিণীকে স্মারক উপহার দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা

তারুণ্যবান্ধব রাষ্ট্রদূত বেলাল প্রতি বছর অন্তত একবার সস্ত্রীক সফর করেন ওয়াখেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। একসঙ্গে খাবার খান, খোঁজ খবর নেন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাসহ অন্যান্য সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে। এবারও রাষ্ট্রদূতের আমন্ত্রণ পৌঁছে যায় সবার মাঝে। মঙ্গলবার সারা দিনের কর্মব্যস্ততার পর সন্ধ্যায় সকলে একত্রিত হন ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী এশিয়া-প্লাজা রেস্টুরেন্টে। কর্মস্থল থেকে প্রায় এক শ কিলোমিটার দূর থেকে রাষ্ট্রদূতও সস্ত্রীক সেখানে পৌঁছে যান যথাসময়ে। ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় তাদের। পরিচয় পর্বের মধ্য দিয়েই সূত্রপাত হয় আলোচনার। কোন শিক্ষার্থী কী নিয়ে পড়াশোনা করছেন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিশেষ করে বাংলাদেশে ফিরে উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা কে কীভাবে কাজে লাগাতে চান, এই নিয়েই আবর্তিত হয় এই সান্ধ্য আলোচনা।
রাষ্ট্রদূতকে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই শুনতেই বেশি আগ্রহী মনে হলো। ফাঁকে ফাঁকে দু-একটি প্রশ্ন করতেও দেখা গেল। বিশেষ আগ্রহী মনে হলো রাষ্ট্রদূতের সহধর্মিণীকেও যিনি পেশায় একজন চিকিৎসকও বটে।
উপস্থিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে দিনাজপুর হাজি মোহাম্মদ দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক শাহিন আলমের নিকট থেকে শোনা গেল দেশে ফিরে গিয়ে তার দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাজ করার পরিকল্পনার কথা।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক কামরুজ্জামান শুভ্র জানালেন, তিনি কাজ করছেন বাংলাদেশ কৃষি ক্ষেত্রে তথ্য আদান-প্রদানে সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারের ওপর।
মৎস্য সম্পদের উন্নয়নে ঢাকার ওয়ার্ল্ড ফিশ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কাজী আহমেদ কবির কাজ করছেন বাংলাদেশের মৎস্য উৎপাদনের ক্ষমতা বৃদ্ধি নিয়ে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রহিমা নুসরাত রিম্মি টিস্যু কালচার নিয়ে গবেষণারত। ভবিষ্যতে দেশে ফিরে অর্গানিক ফার্ম প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন।
মো. কামরুল হাসান জানালেন অর্গানিক পোলট্রি ফার্ম প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথা।
লাভলু মজুমদার উদ্ভাবনী কৃষি পদ্ধতিতে গ্রামীণ সমাজ বিনির্মাণের আশা নিয়ে নিজেকে তৈরি করছেন।

মতবিনিময় শেষে অংশগ্রহণকারী
মতবিনিময় শেষে অংশগ্রহণকারী

সুমাইয়া হক অমি তার গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশে বিভিন্ন ফসলের রোগ-বালাই নিরাময়ে কাজ করছেন।
শাহনাজ বায়ু দূষণের মতো জটিল সমস্যার সহজ সমাধান খুঁজছেন।
প্রদীপ সাহা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে নোনার আক্রমণ ঠেকাতে কঠোর পরিশ্রম করছেন।
উৎপল ও নাহিনা নগরায়ণের সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি জলাবদ্ধতা দূরীকরণে খুঁজছেন অধিকতর উদ্ভাবনী পন্থা।
আবুল কাশেম মৎস্য চাষের গুণগত উন্নয়নে বিজ্ঞান নির্ভর সামাজিকভাবে নিরাপদ পদ্ধতি উদ্ভাবনে কাজ করছেন।
গোপাল বিশ্বাস গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশের বন ব্যবস্থাপনায় আমূল সংস্কারে আশাবাদী।
কামরুল হাসান অরগানিক পোলট্রি করার কলাকৌশল রপ্ত করছেন।
সৌমিত্রা, মৌসুমি, নাজনীন, রুমানা দেশে ফিরে শিক্ষকতার পাশাপাশি বাংলাদেশের গবেষণা পদ্ধতিতে পরিবর্তনের আশা করছেন।
এভাবে প্রায় সব শিক্ষার্থীরা দূষণমুক্ত পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থার মাধ্যমে এক সবুজ সমৃদ্ধ বাংলাদেশে গঠনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
ওয়াখেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বাঙালি শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। সবার শেষে কথা বলেন শেখ মুহম্মদ বেলাল। নেদারল্যান্ডসের কর্মপন্থা ও সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো যেমন যার যার কাজে তার গভীর আন্তরিকতার কথা তুলে ধরে তিনি ডাচদের সঙ্গে বিশেষ করে পানি সম্পদ ও কৃষি বিষয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করতে বাংলাদেশ দূতাবাসের চলমান প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেন। বিশেষ করে ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেদারল্যান্ডস সফর কীভাবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে তার বর্ণনা দেন। শেখ মুহম্মদ বেলাল দেশে চলমান ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সরকারের প্রাধিকার কর্মসূচিসহ তুলে ধরেন। এ ছাড়া তিনি বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে

মতবিনিময় শেষে অংশগ্রহণকারী
মতবিনিময় শেষে অংশগ্রহণকারী

বাংলাদেশে অভ্যন্তরে যেকোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতি সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা উল্লেখ করেন এবং বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে কথোপকথনে বাংলাদেশের প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির ও নীতির বিষয়টি অবহিত করারও আহ্বান জানান। তিনি সেই সান্ধ্য আলোচনায় শিক্ষার্থীদের অসুবিধার কথা শোনেন এবং সেগুলো লাঘবে দূতাবাসের বিশেষ করে তাঁর ব্যক্তিগত সহযোগিতার আশ্বাস দেন। উপস্থিত শিক্ষার্থীরাও দূতাবাসের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করেন।
নৈশভোজের ফাঁকেও চলতে থাকে আলোচনা পর্ব। শিক্ষার্থীরা খোলাখুলি তাঁদের অভিজ্ঞতা, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ভাগাভাগি করেন। সকলের আলোচনায় মনে হয়েছে সকলেই দেশে ফিরে একটি কাজ করার অনুকূল পরিবেশ প্রত্যাশা করেন যাতে তাঁরা তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাদের সর্বোচ্চ প্রদানের মাধ্যমে দেশের কৃষিক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন তথা কৃষি বিপ্লব ঘটাতে সমর্থ হন। আলোচনা আর গল্পে কখন যে ঘড়ির কাঁটা রাত এগারোটার কোটা ছেড়ে বারোটা ছুঁই ছুঁই করছে তা কেউ খেয়াল করেননি।
সবশেষে রাষ্ট্রদূত তার সহধর্মিণী ওয়াখেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীকে দূতাবাস কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় নেন।