একটি অসমাপ্ত ঋণ

মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

বাংলাদেশ থেকে জরুরি ফোন এল। মা খুবই অসুস্থ। ঢাকার একটি হাসপাতালের আইসিইউতে তাকে ভর্তি করা হয়েছে। এখনো জ্ঞান ফেরেনি তার। খবরটি শোনার পর থেকে মনটা ভালো নেই। দেশে ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি। একটি আশঙ্কাই বারবার জেগে উঠছে মনে—মাকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পাব তো!
চেক ইন আর ইমিগ্রেশনের বিড়ম্বনা এড়াতে আগেভাগেই বিমানবন্দরে চলে এসেছি। ফলে কোথাও লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়নি। সিকিউরিটি স্ক্যানার পার হয়ে নির্ধারিত গেটের কাছে এসে লাউঞ্জে দাঁড়িয়েছি। দেখি, সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা এক ভদ্রলোক। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। ডান পায়ে তেমন ভর দিতে পারেন না। হাঁটছেন পা টেনে টেনে। ভেতরে এসে তিনি বসলেন। আমিও তাঁর পাশেই বসলাম। তিনি বাঙালি, সন্দেহ রইল না।
অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর থেকেই কোনো আত্মীয়ের অসুস্থতার খবর শুনলেই মনটা কেমন অস্থির হয়ে ওঠে। আর আজ আমার মা হাসপাতালে। বুকের ওপর যেন পাথর চেপে বসেছে। খবরটা শোনার পর থেকেই আমার খাওয়া-ঘুম সব বন্ধ হয়ে গেছে। কতক্ষণে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াব। এই এক ব্যাকুলতায় একটু পরপর বুকটা ব্যথা করে উঠছে। প্লেন ছাড়তে তখনো এক ঘণ্টা বাকি। সময় যেন পাহাড়ের মতো স্থির হয়ে আছে। ভাবলাম, এই ভদ্রলোকের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলি। তাহলে সময়টা হয়তো ভালো কাটবে।

চেহারায় কেমন গাম্ভীর্যের ছাপ। মনে হলো তিনি গভীরভাবে কিছু ভাবছেন। একবার তাঁর দিকে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই আবার দৃষ্টি নত করি। কেমন যেন সংকোচও হচ্ছে আমার। ঠিক তখনই কথা বললেন তিনি নিজেই।
—আপনি ইসহাক হাফিজ।
জি। আপনি! আমাকে চেনেন?
—অবশ্যই চিনি। আপনার লেখা আমি নিয়মিত পড়ি।
আচ্ছা! অনেক বড় ভাগ্য আমার।
—আমার নাম আলম। আমাকে আপনি চিনবেন না। চেনার কথাও নয়। কারণ, এখানকার বর্তমান বাঙালি কমিউনিটিতে আমার মেলামেশা তেমন নেই।
জি। বলুন।
—কী সব কাল দেখুন। ছোট্ট একটা দেশের মানুষ আমরা। আত্মীয়স্বজন ছেড়ে এই পরবাসে। অথচ এই দল, ওই দল, এমন নানান রকম দলাদলির কারণে বাঙালি পরিচয়ে আমরা এককভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছি না এখানে। এসব আমার ভালো লাগে না ভাই।
আহা। এই কষ্টটা ভাই আমারও। এ দেশে বসবাস করা অন্য কোনো জাতির মধ্যে এ ব্যাধিটা নেই। শুধু আমাদের মধ্যেই।
—ভাই, এবার বলুন। দেশে যাচ্ছেন বুঝি?
জি। আমার মা অসুস্থ। হাসপাতালে আছেন।
—আপনার মা অসুস্থ! তারপর কিছুক্ষণ কী যেন ভেবে বললেন, আহা ভাই। জীবনে এ সময়গুলো খুব কষ্টের। শুভ কামনা রইল।
এবার তিনি নীরব। এরই মধ্যে ডান পাটা সোজা করে নিজের সুবিধামতো বসলেন। মিনিট দুই পর বললাম, আলম ভাই, আপনার পায়ে মনে হয় ব্যথা।
—ব্যথা তো বটেই। এই ব্যথার মধ্যে বিরাট বড় এক ব্যথার কাহিনি জড়িয়ে আছেরে ভাই।
জি ভাই। বলেই চেয়ে রইলাম তাঁর মুখের দিকে। তখনো তিনি বলছেন না কিছুই। তাই আগ্রহ নিয়ে বললাম, ভাই, দেশে কোনো ওকেশনে যাচ্ছেন, তাই না?
একটা হালকা নিশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন—কোনো ওকেশনে নয়। স্থায়ীভাবে। অস্ট্রেলিয়ায় আর ফিরব না।
এ পর্যায়ে তাঁর চেহারায় অস্পষ্ট কষ্টের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঠোঁটের কোণে একঝলক হাসির ব্যর্থ চেষ্টা করে বললাম, ভাই, একটা লাগেজ আর একটা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে এই অস্ট্রেলিয়ায় ল্যান্ড করি আমরা। কত চড়াই-উতরাই পার হয়ে, সম্পূর্ণ শূন্য থেকে শুরু করে একদিন অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট পাই। গাড়ি-বাড়ি প্রতিপত্তি সব হয়। এই পরবাসে এত পরিশ্রম করি শুধু একটু সুখের আশায়। সব ফেলে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরছেন। কোনো কারণ আছে নিশ্চয়ই।
আমার দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থেকে বললেন—সুখের আশা? সত্যিই বলেছেন। নইলে এত কষ্ট কীসের জন্য। তবে আমার বেলায় তা আর হলো কই।
ভাইয়ের পায়ে সমস্যা দেখছি, কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল বুঝি।
—না রে ভাই। সেটা কোনো স্বাভাবিক অ্যাকসিডেন্ট ছিল না...বলেই তিনি থেমে গেলেন।
আগ্রহ নিয়ে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে আছি। বুঝতে আর অসুবিধা হলো না, তিনি কী যেন বলতে চান। তাঁর মনের ওই জগৎটা একপলক দেখার জন্য আমার ব্যাকুলতা টের পেয়েই হয়তো একপর্যায়ে তিনি বলতে শুরু করেন।
—ভাই, একটা মর্মান্তিক স্মৃতি। সব সময় মনে পড়ে। স্মৃতিটা প্রায় পাঁচ দশক ধরে আমাকে তাড়া করে ফিরছে। ভুলে থাকতে অনেক চেষ্টা করেছি। কিছুতেই পারছি না। গত ডিসেম্বরে আমার স্ত্রী মারা যায়। মেয়েটারও বিয়ে হয়েছে আজ পাঁচ বছর। মেলবোর্নে থাকে। দুই বছরের ছেলে, স্বামী, সংসার নিয়ে সে ভালোই আছে।
তার মানে ভাবি মারা যাওয়ার পর থেকে সিডনিতে আপনি একা থাকছেন।
—জি। এত দিন সংসারের মায়ায় মনটাকে যা হোক সান্ত্বনা দিতে পারতাম। এখন আমার খুব কষ্ট।
জি, খুবই স্বাভাবিক। জীবনের এই পর্যায়ে এসে একা। ভাবতেই খারাপ লাগছে।
কিছুক্ষণ নীরবতার পর তিনি বললেন—ভাই, আমার চিন্তাচেতনা হয়তো অনেকের সঙ্গেই মিলবে না। কারণ, আমি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। দেশের জন্য লড়াই করেছি দেশকে স্বাধীন করার জন্য।
মনটা হঠাৎ কেমন করে ওঠে। তাঁর মুখের দিকে অপলক চেয়ে বললাম, আপনি মুক্তিযোদ্ধা! কোন সেক্টরে ছিলেন আপনি?
—দুই নম্বর সেক্টরে। আগরতলার মেলাঘরে এ টি এম হায়দারের কাছে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছিলাম।
জি, তারপর?
—না, ভাবছি, অসুস্থ মাকে দেখতে দেশে যাচ্ছেন। এ সময় যুদ্ধের কথা শুনতে কি ভালো লাগবে। আপনি লেখক। খুবই সেনসিটিভ মন আপনার।
ভালো লাগা না লাগা দূরে থাক, ভাই। আমি শুনতে চাই।
—ইসহাক ভাই, একটা কথা প্রায়ই ভাবি। যুদ্ধ যাঁরা করেছেন, তাঁদের সবার বুকের ভেতর একটা করে গল্প আছে। এই গল্পগুলো স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মের জানা থাকা দরকার।
জি, একেবারে খাঁটি কথা!
—ঠিক আছে। সংক্ষেপেই বলি। শুনুন। আমাদের বাড়িটা ভারতের সীমান্ত থেকে খুব বেশি দূরে নয়। আমাদের প্রতিবেশী অনেকেই ওপারে শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নিয়েছে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই। বাড়ির পাশেই পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প। যখন-তখন গোলাগুলি শুরু হয়। যেকোনো সময় ধরা পড়তে পারি। মারা পড়তে পারি। সীমান্ত পাড়ি দিতে প্রায় প্রতিদিনই প্রস্তুতি নিই। মায়ের জন্য পারি না। বারবারই বেঁকে বসেন। তার একই কথা, স্বামীর ভিটা ছেড়ে কোথাও যাব না। মরার আগে তোর বাবা আমারে নিষেধ কইরা গেছে। এই এক খেয়ালে মা অনড়। কী আর করা। ঠিক এমন সময় একদিন সকালে আমার প্রিয় বন্ধু ও সম্পর্কে চাচাতো ভাই রঞ্জু এসে হাজির। তখন মা আর আমি আমাদের রান্নাঘরে বসে নাশতা খাচ্ছিলাম।

মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

ওর মা ছিল বেশ সুন্দরী। এক রাতে হঠাৎ ওদের বাড়িতে চিৎকার শুনে গিয়ে দেখি, ওর দাদু বিলাপ করে কাঁদছেন। বউমাকে আর্মিরা ধরে নিয়ে গেছে গো। এখন কী হবে। এসব। ওর বাবা তখন পাগলের মতো ছোটাছুটি করছিল। পরদিন থেকে ওর বাবাও আর নেই। তারপর থেকেই ওর আচার-আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। এসেই বলে, মা, খিদায় মরে যাচ্ছি। গত দুই দিন কিছু খাইনি। তাড়াতাড়ি খাবার দাও।
ওকে দেখেই আমার গলা যেন আটকে আসছে। কী বলব না বলব ভেবে পাচ্ছি না। আমাকে উদ্দেশ করে বলল, দোস্ত, ওপারে হায়দার ভাইয়ের কাছে ট্রেনিং নিছি। কাজ শুরু করে দিছি। মা বাধা দিয়ে বলল, বাবা রঞ্জু, তুই যত তাড়াতাড়ি পারিস ওই পারে চইলা যা। ওরা তোকে মেরে ফেলবে।
মা গো মা। আমার আর বাঁচা-মরা কীসের। বলেই ওর কণ্ঠ জড়িয়ে এল।
এরই মধ্যে মা ওকে নাশতা দিয়ে বলল, বাবা রে, তোকে অনুরোধ করি। তুই ওই পারে চইলা যা এখনই।
সে সোজা উত্তর দেয়, না মা, বাপ-মা হারাইছি। আমার আর আছে কী। এখন এই দেশই আমার সব। কোথাও যাব না।
রঞ্জু আলুভাজি দিয়ে এক টুকরো রুটি মুখে দিয়ে আর গিলতে পারছে না। মা পানির মগটা এগিয়ে দেয়। ঠিক তখনই চারজন আর্মি এসে বাজ পাখির মতো ছোঁ মেরে ‘দুশমন মিল গ্যায়া’ বলে উল্লাস করতে করতে আমাকে আর রঞ্জুকে থাবা মেরে ধরে ফেলে। রঞ্জু পানিটুকুও খেতে পারল না। বুঝতেও পারলাম না কী থেকে কী হয়ে গেল। যুদ্ধ কী, দেশে কেন যুদ্ধ হচ্ছে, এ বিষয়ে তখনো আমার ভালো ধারণা ছিল না। আমাকে ধরল কেন, এই জবাব আজও পাইনি।
আমাদের বাড়ি থেকে গুদারাঘাট প্রায় পাঁচ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে। আর্মিরা আমাকে আর রঞ্জুকে নিয়ে হাত-পা বেঁধে ঘাটের বটগাছটার গোড়ায় ফেলে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চালায় এলোপাতাড়ি লাথি। তারপর ওরা প্রথমে ধরল রঞ্জুকে।
এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কে কে? ওরা কোথায় আছে? ওদের অস্ত্রাগার কোথায়? এমন নানান প্রশ্ন করতে লাগল। ওদের কোনো কথারই জবাব দিচ্ছে না সে। ফলে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। তাদেরই একজন আমাকে ইশারা করে বলল, তোমহারে হালত বি এয়ছি হোগি। প্রথমে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ওর চোখদুটো তুলে নেয়। তারপর একজন রঞ্জুর গলাটা পা দিয়ে চেপে ধরলে আরেকজন মুখ থেকে বেরিয়ে যাওয়া জিহ্বাটা টান দিয়ে কেটে নেয়।
যা হোক, নিরীহ বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারের এমন হাজারো কাহিনি আছে। এসব কমবেশি আমরা সবাই জানি। এগুলো নতুন কোনো বিষয় নয়। যে মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়ছে, তার অবস্থা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরে শুনেছি, রঞ্জু যখন আমাদের বাড়িতে আসে, তখন ওই এলাকার একজন প্রতাপশালী লোক নাকি ওকে দেখে ফেলে। সে-ই পাকিস্তানি সেনাদের কাছে খবরটি দেয়। এ ধরনের আরও অনেক কাজ সে করেছে। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে সে গা-ঢাকা দেয়। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর ফিরে এসে ২০০২ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু আমাদের এলাকার চেয়ারম্যান ছিল। যাক। ওসব বলে আর কী হবে।
কিন্তু ওই দৃশ্যটা মনে হলে আজও শরীরটা শিউরে ওঠে। রঞ্জুর গলা থেকে আর্মি পা সরিয়ে নেওয়ামাত্রই সে উপুড় হয়ে মাটিতে চুমু খেতে লাগল। এ অবস্থায়ই ওর পিঠে রাইফেল ঠেকিয়ে গুলি করা হলে সে বারবার তার কপালটাকে মাটিতে ঠেকাতে থাকে। একসময় ওর শরীরটা একটু নিস্তেজ হয়ে এলে কী মনে করে ওদেরই একজন রঞ্জুর হাতের বাঁধন খুলে দেয়।
এ পর্যন্ত বলে আলম ভাই নীরব।
নীরবতা যে এত ভারী, জীবনে এই প্রথম টের পেলাম। তাঁর কাহিনির সঙ্গে সঙ্গে আমিও যেন আলম আর রঞ্জুর মাঝে মিশে যাচ্ছি। চোখের পাতা ভিজে আসছে।
এ সময় তিনি বলতে থাকেন—তখন রঞ্জু তাঁর থরথর করে কাঁপতে থাকা দুটি হাতে মাটিটাকে আদর করতে শুরু করে একজন বাবা যেমন করে তার সন্তানকে আদর করে। তারপর ওর শরীরটা একসময় নিস্তেজ হয়ে গেলে একজন আর্মি নানা রকম গালাগালি করতে করতে কাছে এসে আমার ডান পায়ে রাইফেল ঠেকিয়ে গুলি করে। আর চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘কুত্তাকা বাচ্চা! মুঝে বাতাও মুক্তি কাঁহা হ্যায়?’ শুয়োর কা বাচ্চা, মুঝে বাতাও হাতিয়ার কা গুদাম কাঁহা?’
গুলি খেয়েছি, জীবনের আশা তো আর নেই। মেরে তো ফেলবেই, তখন বারবার মায়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ভেসে উঠছে বাবার মুখটাও। হাত-পা বাঁধা। প্রাণপণ শক্তিতে আমার বুকে রাইফেল তাক করে রাখা আর্মির পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে জীবন ভিক্ষা চাই। ঠিক তখনই দেখি, আমার বড় মামা দৌড়ে এসে আর্মিদের হাতেপায়ে ধরে বলল, ‘ইয়ে এতিম হ্যায়। আওর আপনি মাকা একলা থা বেটা হ্যায়, ইয়ে মুক্তি নেহি হ্যায়।’ তারপর আর কিছুই আমার খেয়াল নেই।
একদিন চোখ খুলে দেখি, আমি আগরতলার মেলাঘরের ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’-এর বেডে পড়ে আছি। ওই সময় আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। শক্ত বুটপরা পায়ের অসংখ্য আঘাত সারা শরীরে। রক্ত জমে শরীরটা নীল হয়ে আছে। ক্ষতস্থান দিয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে।
তারপর পায়জামা টেনে হাঁটুর সামান্য নিচে ক্ষতস্থানটি দেখিয়ে বললেন—পায়ের এখানে দুটো হাড়ের একটা ভেঙে গুঁড়া হয়ে যায়। কিছুতেই ঠিক করা গেল না দেখে ওরা এখানে রড লাগিয়ে দেয়। প্রায় তিন মাস পর যখন দাঁড়াতে পারি, ডাক্তারের পরামর্শমতো প্রতিদিন হাঁটতে বের হই। এমনই একদিন হাঁটতে বের হয়ে সোজা চলে যাই হায়দার ভাইয়ের কাছে। দেশকে মুক্ত করার জন্য আমার রক্তে তখন আগুন ধরে যায়। সময়টা অক্টোবরের মাঝামাঝি। হায়দার ভাই আমার শরীরের এ অবস্থা দেখে প্রথমে রাজি হতে চাননি। পরে আমার মনের জোর দেখে ট্রেনিং দিতে সম্মত হন। ট্রেনিং শেষ করে দেশে এসে যুদ্ধ শুরু করি। হায়দার ভাই বাড়িতে যেতে নিষেধ করলেন। উপায়ও ছিল না। পরিস্থিতি ভয়াবহ। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, মা নেই। কোথায় আছেন কেউ জানে না। আমার মনের অবস্থা তখন রঞ্জুর মতোই। বাঁচা-মরার পার্থক্য তখন আমার মনেও কাজ করছিল না। দেশের প্রতিটি মা-বোনই তখন আমার মা-বোন। তত দিনে অবশ্য যুদ্ধটা আমাদের আয়ত্তে চলে আসে। যুদ্ধের কৌশল মোটামুটি সবাই বুঝে ফেলে। সাধারণ লোকজনও তখন দলমত-নির্বিশেষে খুব শক্তভাবে ঘুরে দাঁড়ায় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। ওদের তখন এক গ্লাস পানিও দিত না কেউ। অবশেষে বিজয় এল ১৬ ডিসেম্বর।
১৮ ডিসেম্বর তারিখে এলাকায় গিয়ে দেখি, বাজার নেই, জমিতে ফসল নেই। গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে ছারখার। আমাদের ভিটাটা ফাঁকা। খাঁ–খাঁ করছে। মা নেই! আমার মা কোথায়? কেউ জানে না। অনেক চেষ্টা করেছি, এখনো করছি, মায়ের খোঁজ আজও পাইনি। আর মামা? পরে জানতে পারি, স্বাধীনতার পরের দিন প্রকাশ্য দিবালোকে আমার বড় মামাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। সে নাকি রাজাকার ছিল। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে তার ভালো যোগাযোগ ছিল। এলাকার সুন্দরী মেয়েদের খোঁজ দিত পাকিস্তানি ক্যাম্পে। আর তখনই মেয়েদের ধরে নিয়ে যেত। ক্যাম্পে দিনের পর দিন আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন করত। কেউ গর্ভধারণ করলে পেটের ওপর লাথি মেরে তাকে মেরে ফেলত।
যা হোক, তারপর শুরু হলো আমার জীবনসংগ্রাম। বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই। কলকারখানা সব বন্ধ। গরু নেই, চাষবাস নেই, কারও কোনো কর্মসংস্থান নেই। এলাকা বিরানভূমি। খারাপ লোকজনের উৎপাত খুব বেড়ে গেল। যেখানে-সেখানে মানুষ আইন হাতে তুলে নিতে শুরু করল। একটু বিবেক-বিবেচনা যে মানুষটার আছে, তার সামনেই কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার। ভিক্ষা করেও দিনে এক বেলা খাবারের সংস্থান হয় না। তারপর, বলতে গেলে খিদার জ্বালায় অজানার উদ্দেশে একদিন বের হয়ে পড়ি। প্রায় চৌদ্দ বছর চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করি। অবশেষে অনেক চেষ্টার পর জাহাজে চাকরি পাই। বিভিন্ন দেশ ঘুরে সেবার অস্ট্রেলিয়ায় নেমে পড়ি। জাহাজে আর ফেরত যাইনি। তখন আমার মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর এক প্রান্ত এ দেশ। এ দেশে হয়তো যুদ্ধবিগ্রহের সম্ভাবনা কম। ওই রকম দৃশ্য হয়তো এ দেশে দেখব না আর। কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা কষ্টের স্মৃতিকে বড় ভয় পায়। আমি তাদেরই একজন।
সত্যিই তাই। এমন দৃশ্য এ দেশে কোনো দিন দেখিনি। এখানে জীবনযুদ্ধ, সে আরেক কাহিনি। জীবনে খিদার কষ্ট যে কত নির্মম, তা যুদ্ধ শুরু হওয়ার দিন থেকেই টের পেতে শুরু করি। বিষধর সাপ যাকে একবার দংশন করেছে, পরবর্তী সময়ে সে সাপের নামটা শুনলেই ভয়ে শিউরে ওঠে। ওই রকম আর কি।

মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

—এ দেশে আপনারা তো ভাই স্টুডেন্ট। একটা গন্তব্যকে টার্গেট করে এগিয়েছেন আপনারা। আমাদের সময়টাতে এমন সুযোগ ছিল না। ওই সময় আমরা এমন যে কজন ছিলাম, শুকনো পাতার মতো রাস্তায় উড়তাম কেবল। শত অনিশ্চয়তার মাঝেও যন্ত্রের মতো চাকরি করে গেছি। অতীতকে ভুলে থাকতে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি। এত ব্যস্ততার মাঝেও ওই দৃশ্যটা মনে পড়ে যেত। যখন-তখন চোখের পাতা ভিজে আসত।
এই ভাবনা থেকেই আমার খোঁড়া পায়ে চাকরি করে আস্তে আস্তে উনিশ বিঘা জমি কিনেছি। বছর তিনেক আগে মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়। এখানে ওয়ালি পার্কের বাড়িটা বিক্রি করে বিল্ডিংয়ের কাজে হাত দিই। পাশাপাশি দক্ষিণমুখী আর পূর্বমুখী দুটো তিনতলা বিল্ডিংয়ের কাজ গত মাসে শেষ হয়। আমার ফুফাতো ভাই মাহি, সে-ই আন্তরিকভাবে দেখাশোনা করছে সব। আমাদের এলাকায় একটা স্কুল নেই। তাই স্থির করেছি, একটা হাইস্কুল করব। আমাদের বাড়িটার অবস্থান দক্ষিণ প্রান্তে। ওখানে ঠিক এমনভাবেই দুটো ঘর করেছি, যে ঘরে মা-বাবার মমতায় জড়াজড়ি করে বড় হয়েছিলাম। আঙিনায় বসে আমি চেয়ে থাকব, যখন আমার স্কুলে ছেলে-মেয়েরা মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করবে। আমি দেখব, আমার ভাই রঞ্জুর রক্তে ভেজা মাটিতে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হচ্ছে কিছু ছেলে-মেয়ে।
এ পর্যন্ত বলে তিনি একটু থামলেন। হঠাৎ মনে হলো, শরীরটা যেন শীতল হয়ে গেছে। মনে মনে কামনা করছি, আলম ভাইয়ের এই পবিত্র চেতনা ছড়িয়ে পড়ুক আমাদের সকল প্রবাসীর মাঝে। লাখো শহীদের রক্তে ভেজা আমাদের এই দেশটার কল্যাণে এভাবেই উৎসর্গ হোক আমাদের কর্মময় পরবাসী জীবন।
ইতিমধ্যে বোর্ডিংয়ের ঘোষণা এল। দেশে অনেকবার গিয়েছি। দেশে যাওয়ার আনন্দ বর্ণনাতীত। তবে আজ সারা দেহমনে কী এক অচেনা শিহরণ। শুধু দেশকে যারা ভালোবাসে, তাদের সংস্পর্শেই বুঝি ওই শিহরণ অনুভব করা যায়। প্লেনের মধ্যে আলম ভাইয়ের পাশে বসা যাত্রীকে অনুরোধ করে আসন বদল করে এসে বসলাম তাঁর পাশে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেন আকাশে উড়ল। ক্রমে পেছনে সরতে লাগল অস্ট্রেলিয়া আর কাছে আসতে লাগল আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।

(লেখকের ইমেইল: <[email protected]> Facebook: <Ishaque Hafiz>