এরাও মানুষ-দুই

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আমার মনে হয় আমার জীবনে দ্বিতীয় জন্ম হয়েছে যখন আমি মন্ট্রিয়েলে আমার দেড় মাসের বাচ্চা নিয়ে মাস্টার্স করতে গিয়েছি। প্রথম সংসার, প্রথম সন্তান, প্রথম বিদেশ বাস এবং সেই সঙ্গে মাস্টার্স। প্রথমেই যেটা টের পেলাম সেটা হলো অর্থাভাব। স্কলারশিপের টাকায় সংসার চলবে না। আমি বাচ্চা নিয়ে মাস্টার্স করে কাজ করতে পারব না। কাজ করবে আমার বর। যেকোনো একটা কাজ লাগবে। আমার বরের ক্যাডেট কলেজের এক জুনিয়র এক রেস্তোরাঁয় কাজ করত। সেখানে কাজ জুটে গেল।
কিন্তু আমাদের বাচ্চা থাকবে কোথায়? ওই দেশে সরকারি ডে কেয়ারে সিট পাওয়া বেশ কঠিন। প্রাইভেট ডে কেয়ার সাধ্যের বাইরে। তা ছাড়া, তখন পর্যন্ত একটা ভুল ধারণা ছিল, বিদেশি সব মেয়ে, কঠিন হৃদয়, কীভাবে না কীভাবে আমার সবেধন নীলমণিকে লালন পালন করবে, তার কোনো ঠিক আছে? এদিকে দিন দুই একের মধ্যেই কাউকে লাগবে বাচ্চা রাখার জন্য। হাত বাড়িয়ে দিলেন রেস্তোরাঁয় কাজ করা এক সিলেটী ভাই। সেও ফেরারি, দেশে যাওয়ার উপায় নাই।
বাংলাদেশের বাইরে পা দিলে বোঝা যায় যে সিলেটীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন বহু আগে থেকেই। তাদের আত্মীয়স্বজন, পরিচিত মানুষও অনেক বেশি। সেই সূত্র ধরে ভাই নিয়ে গেলেন এক সিলেটী ভাবির কাছে। ছোট্ট এক বেডরুমের দমবন্ধ ফ্ল্যাট। সাত কড়ার তীব্র গন্ধে মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে। সেই ভাবি পান খেতে খেতে রাজি হয়ে গেলেন আমার বাচ্চাকে রাখতে। ভাগ্যিস সিলেটী ভাই সাহায্য করেছিলেন। অল্পশিক্ষিত সেই খাঁটি সিলেটী ভাষিণী আমার ছেলের কোনো অযত্ন করেননি। অতি সততার সঙ্গে দিনের শেষে দুঃখ করে বলতেন যে, আমার ছেলেকে অনেক চেষ্টা করেও তিনি সারা দিনে সামান্যই খাওয়াতে পেরেছেন। এমনও দেখেছি ওনার হামাগুড়ি দেওয়া ছেলেকে পাশে রেখে তিনি আমার ছেলেকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছেন। ওই সময় ওই ভাবির সাহায্য না পেলে আমাদের সংসার চালানো ও আমার পড়ালেখা চালানো সম্ভব হতো না। 

বিদেশে এসে মা, খালা, শাশুড়ি, বড় বোন পাইনি। পেয়েছি এই সব অচেনা, কমশিক্ষিত ভাবি যারা আসলেই আমার জন্য অনেক করেছেন। ডালাসে যখন এসেছি কানাডা থেকে, তখন ছেলেটা স্কুলে যায়। মেয়েটা দেড় বছর। একই সমস্যা, দিনেরবেলা কার কাছে থাকবে। এইবারও পেয়ে গেলাম আরেক ভাবি, পাশের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে। শুধু ভাবি না, আসলে পেলাম ভাই-ভাবি দুজনকেই। সেই মুহূর্তে তাদের কারওরই হাতে কাজ নাই। ভাবি তাদের বাচ্চাটাকে আর আমার মেয়েটাকে দেখেন। কিন্তু খাওয়ানোর সময় আমার মেয়ে খালি ভাইয়ের হাত থেকেই ভাত খেত।

কানাডায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শিশু-কিশোররা। সংগৃহীত
কানাডায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শিশু-কিশোররা। সংগৃহীত

শুধু তাই না, এই অর্থ কষ্টের মধ্যেও ওই ভাবি, একটু ভর্তা, ভাজি কিছু না কিছু প্রতিদিন আমাকে দি​তেন। মেয়েকে তুলতে যেতাম। লাজুক মুখে একটা-দুইটা বাটি দিয়ে বলতেন, আপনারা সারা দিন চাকরি করে কি আর রান্না করার সময় পান? ভাবির হাতের রান্না ছিল অমৃত।
কয়েক মাস পরে সেই ভাই একটা কাজ পেলেন, ঘড়ি ধরা অফ টাইম। প্রতিদিন সেই অফ টাইমে ভাই ওনার বাসায় ফোন করে আমার মেয়ের সঙ্গে কথা বলতেন। আমার মেয়ে কিন্তু তখন পুরোপুরি কথা বলে তা নয়। ভাইয়ের ওকে বাসায় রেখে কাজে গিয়ে নাকি ওর জন্য খারাপ লাগত। সে অনেক দিন আগের কথা। আমার মেয়ের হয়তো কাজল ভাই বা কাকলি ভাবির কথা মনে নাই, কিন্তু তারা যে যত্নে আমার মেয়েটাকে লালন পালন করেছেন, সেই ঋণ আমি আর আমার বর কোনো দিন শোধ করতে পারব না।