ছোট ছোট স্বপ্নের নীল মেঘ

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

ছোটবেলা আমার খুব বাগান করার শখ ছিল। তখন বাংলাদেশে আমাদের গ্রামের বাড়িতে থাকি। বাড়ির সামনে পুকুরের পাশের পতিত জমিতে বাগান করতাম। নার্সারি থেকে বিভিন্নরকম ফুলের গাছ কিনে এনে সেখানে লাগাতাম। সেই বাগানের মাটিতে প্রথম রোপণ করার পরপরই কেমন যেন ফুলের গাছগুলোর ডালপালা নুয়ে পড়ে মরে যাওয়ার মতো অবস্থা হতো। নতুন মাটি, নতুন পরিবেশ, বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে গাছগুলোর যেন অনেক কষ্ট! আমার তখন খুব মন খারাপ হয়ে যেত। প্রতিদিন গাছের গোড়ায় পানি দিতাম, পাতা ছুঁয়ে দিতাম যতন করে। দিন যায়, তারপর একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে যখন দেখতাম গাছগুলো ডালপালা ছড়িয়ে সদর্পে সেই নতুন মাটির ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেছে। তখন অনাবিল আনন্দে মন ভরে যেত। এরপর একদিন কোনো এক স্বপ্নের দিন যখন বাগান হয়ে উঠত বর্ণিল, বিভিন্ন রঙের ফুলে সুশোভিত, সেদিনের প্রাপ্তি আকাশের সীমানাকে হারিয়ে দিত। বাগানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুই চোখ বন্ধ করে বুক ভরে বাতাস নিতাম। নিশ্বাসে যেন স্বর্গীয় ঘ্রাণ।

প্রায় এক দশক আগে প্রথম যখন আমেরিকায় আসি, আমার অবস্থা সেই ছোট্ট গাছটির মতোই ছিল। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ, নতুন আবহাওয়া, নতুন সবকিছু। গোড়ায় কে পানি দিয়েছিল জানি না, পাতায় কে হাত বুলিয়ে দিয়েছিল তাও জানা নেই। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই গাছটি মাটির ওপর দাঁড়িয়ে যেতে থাকে মাথা উঁচু করে। আপন করে নিতে থাকে সেই অচিন জগৎ। অচেনা কষ্ট, অজানা শঙ্কা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, ওই দূর সীমান্তের অদৃশ্য গন্তব্য; শুধু পথচলা ছিল নিরন্তর।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

তারপর দিন যেতে থাকে সময়ের নিয়মে। গাছের শিকড় সেই অচেনা মাটি আঁকড়ে ধরে সজোরে। ডালপালা মেলে বিস্তৃত হয় তার সীমানার গণ্ডি। ফুলের সুগন্ধে বাগান ভরে ওঠে। অজানা পাখিরা আসে সেই দূর দুরান্ত থেকে। কিচিরমিচির করে ভরিয়ে তুলে সময়। গাছের নিচে গাছ হয়। যদি নিয়তির সঙ্গে ক্ষান্তি দিতেই হয়, তবে কেন জীবনের প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি অনুভূতিকে দিতে হবে বিসর্জন! তাই ভিনদেশের এই মাটি, এই প্রকৃতি, এই পরিবেশের সঙ্গেই হয়ে ওঠে মিতালি। এই আকাশ, এই বাতাস, এই মাটি যেন আমার অনেক দিনের চেনা। জীবনের বাকি সব লেনদেন বুঝে নেবার হয়ে এসেছে সময়।
মহাকালের নিয়মে পৃথিবী ঘুরে আসে। সময় ঘুরপাক খেতে থাকে কৃষ্ণগহ্বরের বুকে। এরই মাঝে কোনো এক দিনের শেষে ঘনকালো অন্ধকার রাত্রির যেন অপেক্ষা। কালবৈশাখী আর রাত্রির ষড়যন্ত্র, সজোর দমকা হাওয়া বয়ে যায় দুনিয়াজুড়ে। রাত্রির তাণ্ডব শেষ হয় ভোরের আলোর তাড়া খেয়ে। বাগানের গাছগুলো শুধু ভেঙেচুরে যায়। আমি ক্ষান্তি দিই না, ক্ষান্তি দেওয়ার আমাদের নেই যা জানা। আবারও লেগে যাই আমার সেই ফুলগাছের পরিচর্যায়। গাছের গোড়ায় পানি দিই, পাতায় বুলিয়ে দিই মায়ার পরশ। নিয়তির দিকে কটাক্ষ দৃষ্টি, আমার ফুলের গাছগুলো আবারও সতেজ হতে থাকে, কচি কচি পাতা গজায় তার ডালে ডালে। তারপর আবার ফুল আসে, পাখিরা আসে, গান করে।
হাজারোটি দিন কেটে গেছে। তারপর গেল বছরে কোনো একদিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙা চোখে দেখেছিলাম আমাদের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এক অদৃশ্য কালবৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব। সেদিন ঠিক সেই ফুলের গাছটির মতোই মনে হয়েছিল হঠাৎ সবকিছু যেন ভেঙেচুরে গেছে। চেনা মাটি, চেনা হাওয়া আর চেনা পরিবেশ যেন মুহূর্তের জন্য হয়ে উঠেছিল অচেনা, অজানা। নিয়তির সঙ্গে দাবার গুটি চালানো, ক্ষান্তি দিলে তো আমাদের চলে না। তাই আবারও জেগে উঠি মাথা উঁচু করে সদর্পে। আগামীর সূচনায় পথ চলা শুরু করি, আরেকটি দিনের হয় জন্ম। ওই দূর দিগন্তে দাঁড়িয়ে আছে আরও কতশত কালো রাত। পথের সব জঞ্জাল সরিয়ে রাত পাড়ি দেব ভোরের আলোর সঙ্গে হাত মেলাতে। তারপর আবার আঁকড়ে ধরব এই মাটি।
বাগান করবার শখ কিন্তু আমার এখনো যায়নি। এখানে আমাদের আছে একখানা ছোট্ট কুটির। সেখানে বউ বাচ্চা নিয়ে বেঁধেছি একটি নীড় বাবুই পাখির মতো। সেই বাড়িতে ওঠার পরেই প্রথমে বাড়ির পেছনের দিকের উঠোনে বাগান করেছি। লাগিয়েছি ফুলের গাছ সেই ছোটবেলার মতোই। অফিস থেকে ফিরে কোনো এক বিকেলবেলা অলস সময় কাটাই সেই বাগানে বসে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি কীভাবে সেই ছোট্ট গাছগুলো আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিবাদী সেই আত্মনির্ভর গাছের ডালপালা বেয়ে হাওয়ারা এসে আমার গা ধুয়ে দিয়ে যায়, ছুঁয়ে দিয়ে যায় মনের মাঝখানে অজানা প্রশান্তির রং।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

বছর ঘুরে আসে। গ্রীষ্মের দাবদাহ রোদ, শীতের কনকনে ঠান্ডা আর তুষারপাত, সব রকম বৈরী পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে পথচলা। ভেঙে পড়া গাছের ডাল সুযোগ পেলেই আবার মাথা খাঁড়া করে দাঁড়ায়। বীরদর্পে উঁকি দেয় আকাশের পানে। মাথা নোয়াবার যেন নয়। আমরাও অশ্বত্থ গাছের মতো বিশাল হব, ছড়িয়ে পড়ব সবখানে সকল বাধা উপেক্ষা করে। বিলিয়ে দেব নিজেকে উজাড় করে মানবতার তরে। অশরীরী শক্তি সঞ্চয় করে একদিন কৃষ্ণগহ্বরের মতো সকল আলো চুষে নেব।
সময়ের নিরন্তর চলা। আমার সেই ছোট্ট বাগানে নিয়তই ফুল আসে, কতশত রঙিন ফুল। পাখিরা আসে, গান করে, বুনে কত স্বপ্ন। ছোট ছোট স্বপ্নের নীল মেঘ!

লেখক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের সাবেক সহকারী অধ্যাপক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত।

*এটি ধারাবাহিক রচনা। আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন