জ্যোৎস্না বিলাস

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

‘তুই তো জানিস, পৃথিবীতে আসার আগে একা ছিলাম। এটাও ভালো করে জানিস এখান থেকে বিদায়ও নিতে হবে একা একা। তাই বেঁচে থাকার এই স্বল্প সময়টুকুতে একা থাকতে আমার বড্ড হয়। যা হোক ভালোবাসিস আর নাই বা বাসিস আমার একটা চাওয়া, কখনো এক সাথে জ্যোৎস্না দেখতে চাইলে আসবি তো?’

সাহেদের স্যামসাং নোট থ্রি মোবাইলের সিক্স বাই থ্রি সাইজের ডিসপ্লে জুড়ে ওপরের মেসেজটা পুরোটাই দৃশ্যমান। কয়েক মিনিট আগেই নাফিসার পাঠানো এই মেসেজটার টুট টুট শব্দে তার ঘুম ভাঙে।
চুয়াল্লিশ দিন আগে সাহেদের সঙ্গে চুকে বুকে যাওয়ার পর এটাই তার মোবাইল থেকে প্রথম মেসেজ। বছর দেড়েকের রিলেশন তাদের। শেষ তিন মাস ধরে নিজেদের সম্পর্কটাকে উপভোগ করবে তো দূরের কথা তারা একে অপরকে কোনোভাবে সহ্য করতেই পারছিল না। এই খুনসুটি তো, এই মতপার্থক্য। এই ভালো তো, এই ঝগড়া। কিছুদিন পরে ঠিক হয়ে যাবে এই ভাবনাটাকে পুঁজি করে সাহেদ খুব চেয়েছিল সম্পর্কটাকে টেনে নিয়ে যেতে। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়নি। মিউচুয়ালি আলোচনা করেই তাদের ব্রেকআপ!
একুশের প্রভাতফেরিতে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। নাফিসার কাছে সবচেয়ে চমৎকার আর সুন্দর দৃশ্য হচ্ছে একুশের প্রভাতফেরি। শীত শীত ভোরে উঠে খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে শহীদ মিনারে যাওয়া। সেই শিহরণ জাগানো সুর—আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি...। এই সবকিছুই একটা অদ্ভুত আবেশ সৃষ্টি করে। মনটাকে শিশির ভেজা ফুলের মতো সিক্ত করে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়।
নাফিসা পনেরো দিন ধরে প্রস্তুতি নিয়েছিল একুশের প্রভাতফেরিতে যোগ দিতে। মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারে বড় হয়ে ওঠা নাফিসা টিউশনির টাকা দিয়ে কিনেছে বাংলা বর্ণমালা খচিত লাল পাড়ের সাদা শাড়িটা। এই প্রথম প্রভাতফেরিতে হাঁটবে। শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করা কাচের চুড়ি হাতে পরে টিপটা কপালের ঠিক মাঝখানে বসিয়ে আটপৌরে আয়নায় শেষবারের মতো নিজেকে আরেকবার দেখে নিল। বাহ, একেই বলে খাঁটি বাঙালিয়ানা সাজ! না, দারুণ মানিয়েছে। মনে হচ্ছে মনের ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা প্রজাপতিটা আজ ডানা মেলেছে...।
প্রভাতফেরি শেষে রিকশার অপেক্ষায় নাফিসা দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার মোড়ে। দুই হাত দূরে একটি কুকুর। চেহারা কিছুটা ভয়ংকর। মনে হচ্ছে তার প্রতি কুকুরটা বিরক্ত। কারণ কুকুরটা সেখানে আরামসে ঘুমাচ্ছিল। ঘেউ ঘেউ করে দুবার তাকে সাবধানও করছে কুকুরটি। কিন্তু কেন জানি সে ভয় পায়নি।
নাফিসা যেখানে দাঁড়িয়েছে তার কয়েক হাত দূরে টং দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তিন তরুণ। তাদের হাতে দামি ফোন আর কানে হেডফোন লাগানো। ওই তিন ছেলে এমনভাবে তার দিকে তাকাচ্ছিল যেন প্রভাতফেরিতে এসে সে বিরাট পাপ করে বসেছে। একজন তাকে দেখে দেখে বেবি ডল গাওয়া শুরু করেছে। এতক্ষণ রাস্তার কুকুরকে ভয় পায়নি। কিন্তু জিনসের প্যান্ট আর শার্ট পরা দামি ফোনওয়ালা ওই তরুণদের ভয়ে কেন জানি নাফিসা কুঁকড়ে যাচ্ছে।
২০১৫ সালের ১৪ এপ্রিল টিএসসির বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে শ্লীলতাহানির শিকার হওয়া মেয়েটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছিল কারও সাহায্য নেওয়া খুব প্রয়োজন। ঠিক ওই মুহূর্তে তার সামনে দিয়ে যাওয়া একটা চলন্ত রিকশা থামিয়ে রিকশায় বসা সাহেদের কাছে মৌচাক মোড় পর্যন্ত লিফট চেয়ে বসল। সাহেদও একটি মেয়ের এ রকম করুণ অবস্থা শুনে গন্তব্য স্থানে নামিয়ে দেওয়ার জন্য কোনো কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে যায়। নাফিসা আগামাথা না ভেবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যার সঙ্গে রিকশায় উঠে বসল, সেও একই বয়সী যুবক। অথচ ওই ছেলেদের চোখ আর সাহেদের চোখগুলোতে বিস্তর পার্থক্য। একই রকম একটা অপরিচিত ছেলের সঙ্গে রিকশায় গা ঘেঁষে বসে আছে, অথচ নিজেকে কী নিরাপদই না মনে হচ্ছে।
এভাবেই তাদের প্রথম পরিচয়। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে প্রেম...।
সেদিন নাফিসার ভয়ার্ত চোখের কোণে জমে থাকা ভয়গুলোর মধ্যে কোনো প্রণয় খুঁজতে যায়নি সাহেদ। পেতেও চায়নি তেমন কিছু। পরবর্তীতে কোনো এক সময় নাফিসার কপালের লাল টিপ, লাল শাড়ি আর নখের টকটকে লাল নেলপালিশ দেখে নিঃশব্দে খুন হয়ে গেল তার মস্তিষ্ক। রক্তের প্রবাহে শুরু হয় তোলপাড়। মেয়েটির মায়াবী হাসি তার নেশার মাহাত্ম্যকে বাড়িয়েছে দিয়েছিল কয়েক গুণ। তাতে হৃৎস্পন্দন নিয়ন্ত্রণহীন হওয়া শুরু করেছিল। নিজেরই অজান্তে দিনের পর দিন একসঙ্গে কাটানো সময়গুলোতে তার পিচঢালা রাস্তার মতো চোখের অতলে বেঘোরে হারিয়ে গিয়েছিল সাহেদ।
নাফিসাও সাহেদের সরলতায় নিজের স্বপ্নগুলোর রং মেখেছিল। ভালোবাসার কোনো এক তপ্ত রোদ্দুরে সাহেদের হাতটি ধরে হেঁটে যেতে চেয়েছিল গন্তব্যের শেষ সীমানায়। সেও ভালোবাসা খুঁজে ফিরে সাহেদের হৃদয়ের ব্যস্ত ঠিকানায়। নিজেদের অজান্তে নিজেরাই পরস্পরের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
ব্রেকআপের পর নাফিসাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে সাহেদ। বিষয়টাকে পাত্তা না দেওয়ার ভাব করছে সে। প্রিয়জন হারানোর দিন সব সময় আসে না। আজ এসেছে তো কী হয়েছে। একই শহরে খুব কাছাকাছি থাকা মানুষ তারা দুজন। যদি আজ থেকে কেউ কাউকে না খুঁজে তো কী হবে? কাল সূর্য ওঠা বন্ধ হবে? বৃষ্টি হবে না শহরে? নক্ষত্রের মধ্যে সংঘর্ষ লেগে যাবে? জীবন তো জীবনের নিয়মেই চলবে, তাহলে দ্বিধাটা কই আসলে?

লেখক
লেখক

ব্রেকআপের প্রথম কদিন নাফিসাকে ছাড়াই মোটামুটি চালিয়ে যেতে পারলেও কেন জানি সাহেদের সবকিছু ঠিকঠাক মতো হয়ে উঠছিল না। নাফিসাকে প্রচণ্ডভাবে মিস করছিল সে। যদিও তার হাসি মুখ দেখে সবাই ধরে নিচ্ছে সে ভালো আছে। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল দেখে নাফিসার মতো একবারও কেউ দরদমাখা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেনি, রাতে ঘুম হয়নি কেন?
ব্যস্ত জগতে কেউ একজন ছিল যার ব্যস্ততা শুধু তাকে ঘিরে। তাকে বুঝতে চাই, তার কেয়ার নিতে চাই। অথচ সামান্য ইগোটাই দুজনকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে দিনের পর দিন।
একটু আগে আসা নাফিসার মেসেজটার কথা সে জোর করে মন থেকে দূর করতে চাচ্ছে। মন কী আর তার কথা শোনে। মনকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ওপরওয়ালা সবাইকে দেন না। ভেতর ভেতর একটা ভালো লাগা টাইপের উত্তেজনা কাজ করছে। আরেকটু ঘুমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু হচ্ছে না। আর পারল না। ইগোর কাছে শুদ্ধ একটা ভালোবাসাকে কোনোমতে হারতে দেওয়া যায় না।
ঝটপট গোসল সেরে ছাই রঙা জিনসের সঙ্গে আকাশি কালারের টিশার্টটা কোনোমতে পরে নিল। পারফিউমটা মনে হয় একটু বেশি স্প্রে হয়ে গেছে। ঝাঁজালো একটা গন্ধ আসছে। ওদিকে খেয়াল করার সুযোগ কই? জীবনের সবকিছুই সে ফিরে পেতে চলেছে, এমন মহাখুশির জোয়ার তার মনে। তাকে যে নাফিসার সঙ্গে দেখা করার জন্য বের হতে হচ্ছে। নাফিসাকে যে বলতে হবে—প্রিয় মানুষটার সঙ্গে পূর্ণ যৌবনা চাঁদের গা থেকে টুপটুপ করে পড়া জ্যোৎস্না বিলাসের লোভ কেমনে আমি সামলাব?