রুয়ান্ডা গণহত্যা স্মরণ সপ্তাহ

রুয়ান্ডার প্রাকৃতিক দৃশ্য। সংগৃহীত
রুয়ান্ডার প্রাকৃতিক দৃশ্য। সংগৃহীত

‘আমার তখন দুই বছরের মতন বয়স। পাশের বাড়ির লোকজন চোখের সামনেই আমার মা-বাবাকে নির্যাতন করে মেরেছে। মার কোলেই ছিলাম আমি। টের পেয়েছিলাম, মা আমাকে খুব শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন। যেন আমার কোনো ক্ষতি না হয়। অনেক চেষ্টা ছিল তার। যেন বেঁচে থাকেন। কিন্তু ওরা বাবাকে মেরে ফেলার পর আমার মাকে রেহাই দেয়নি। আমি মাকে শক্ত করেই ধরেছিলাম। এরই মাঝে মাকেও মেরে ফেলল। মার প্রাণহীন শরীরটা আমার ওপরেই পড়ে ছিল। ওরা ভেবেছিল আমিও বেঁচে নেই। কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমি বেঁচে গিয়েছিলাম। পরে বাবার এক বন্ধু কোনোভাবে আমাকে নিয়ে গিয়ে ভরণপোষণ করে বড় করেছেন। আমি তার কাছে সত্যিই ঋণী।’ এভাবেই বলছিলেন গণহত্যায় বাবা-মা হারানো রুয়ান্ডার এক যুবক, যিনি এখানে কর্মরত এক বাংলাদেশির গাড়িচালক হিসেবে কাজ করছেন।

রুয়ান্ডার প্রাকৃতিক দৃশ্য। সংগৃহীত
রুয়ান্ডার প্রাকৃতিক দৃশ্য। সংগৃহীত

ঠিক এমনই অনুভূতি ছিল আরেক যুবকের, যিনি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘আশা রুয়ান্ডাতে’ লোন অফিসার হিসেবে কাজ করছেন। তিনিও প্রায় একইভাবে তার পরিবারের সবাইকেই গণহত্যাকালে হারিয়েছেন। যারা এ কাজে জড়িত ছিলেন, বড় হয়ে তাদের কোনো তথ্য জেনেছিলেন কিনা, এমন প্রশ্নে দুজনেরই প্রতিক্রিয়া ছিল এমন—‘হ্যাঁ, জেনেছি, তবে এ নিয়ে আর কোনো প্রতিহিংসা কাজ করছে না বিধায় সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি।’
হ্যাঁ, উপরিউক্ত ঘটনাগুলো ১৯৯৪ সালে সংগঠিত রুয়ান্ডা গণহত্যাকালের। ৭ এপ্রিল থেকে আগামী সাত দিন রুয়ান্ডা গণহত্যা স্মরণ সপ্তাহ হিসেবে পালিত হচ্ছে। এ সময়কালে সারা দেশব্যাপী প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা বা আরও বেশি সময় ধরে স্মৃতিচারণামূলক অনুষ্ঠান চলবে। অফিস-আদালতে কাজ হবে দুপুর ২টা অবদি, যা বাধ্যতামূলক। মানুষ নিজ এলাকায় যাবে, হারানো স্বজনের স্মরণে স্মৃতিচারণা করবে, তাদের নিয়ে আলোচনা করবে এবং সম্প্রীতির কথা সকলের কাছে পৌঁছে দেবে।

রুয়ান্ডার মানচিত্র
রুয়ান্ডার মানচিত্র

গণহত্যা স্মরণ সপ্তাহের এবারের স্লোগান ‘আমাদের সমৃদ্ধির নির্মাণ (Build on our Progress)’ যার সংক্ষিপ্ত অর্থ হলো ভেদাভেদ ভুলে দেশকে গড়ার শপথ করা। পেছনে ফিরে যাওয়া নয় বরং পেছন থেকে শক্তি অর্জন করে দেশের বিনির্মাণে ঝাঁপিয়ে পড়া। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা, অন্যের বিপদে এগিয়ে এসে বিপদমুক্ত করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা। যার চাপ প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিদ্যমান হতে শুরু করেছে এবং উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, আইনশৃঙ্খলা বলুন বা পারস্পরিক সম্প্রীতি বলুন, সকল ক্ষেত্রেই আজ পুরো আফ্রিকার মধ্যে রুয়ান্ডা একটা উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে।
উল্লেখ্য, আজ থেকে ২৩ বছর আগের এমন দিনে সরকারি লাইসেন্সপ্রাপ্ত হয়ে পরবর্তী মাত্র তিন মাসে প্রায় ৮ লাখ লোককে হত্যা করা হয়েছিল। যা থেকে ছোট স্কুলপড়ুয়া বাচ্চারাও রেহাই পায়নি। জানা যায়, ১৯৯৪ সালের ৬ এপ্রিল রুয়ান্ডার তখনকার সরকারপ্রধান হাব্রিমানা ও পাশের দেশ বুরুন্ডির প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমানটিকে রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালিতে গুলি করে তাদের হত্যা করার পরই এ গণহত্যার শুরু হয়েছিল। যদিও এটা কখনোই নিশ্চিত হওয়া যায়নি, আসলে কে এতে জড়িত ছিল। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের সূত্র ধরেই প্রেসিডেনশিয়াল বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী ও হুতু মিলিশিয়ারা মিলে এই হত্যাকাণ্ড শুরু করে। মিলিশিয়া গ্রুপটি ‘ইন্টারহামহুয়ে’ (যারা একত্রে আক্রমণ করে) এবং ‘ইম্পুজামুগামবি’ (যারা একই আদর্শ লালন করে) রাস্তা বন্ধ করে এবং ব্যারিকেড দিয়ে তুতসি ও মডারেট হুতুদের হত্যা করে। এই বাহিনীর প্রথম শিকার ছিলেন তখনকার মডারেট হুতু প্রধানমন্ত্রী এবং তার ১০ জন বেলজিয়ান নিরাপত্তারক্ষী।

রুয়ান্ডার মানচিত্র
রুয়ান্ডার মানচিত্র

পরবর্তীতে এই আক্রমণ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং এমনকি সরকারি রেডিওতে ঘোষণা দিয়ে তাদের প্রতিবেশী তুতসীদের হত্যা করতে প্ররোচিত বা আদেশ করা হয়। যা ৭ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে ১৫ জুলাই (১৯৯৪) অবধি স্থায়ী হয়। এ সময়কালে গির্জা, হাসপাতাল এমনকি স্কুলগুলোতেও অবাধে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক করুন কাহিনি হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আছে। তুতসি সমর্থিত ও ভারী অন্ত্রশস্ত্রেসজ্জিত রুয়ান্ডার প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্টের (আর পিএফ) সহায়তায় প্রেসিডেন্ট পল কাগামের নেতৃত্ব গ্রহণের মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ডের সমাপ্তি ঘটেছিল। যদিও প্রায় ২ লাখ রুয়ান্ডান বিশেষ করে হুতু সম্প্রদায়ের লোককে দেশ ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হতে হয়েছিল।
বলে রাখা ভালো, তখনকার সময়ে যাদের ১০টার বেশি গরু-মহিষ থাকত তাদের তুতসি বলা হতো এবং যাদের এর চাইতে কম গরু-মহিষ থাকত তারা হুতু হিসেবে বিবেচিত হতো। যা তৎকালীন বেলজিয়ান সরকার ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছিল। উল্লেখ্য, রুয়ান্ডা বেলজিয়ামের কলোনি ছিল এবং ১৯৬২ সালে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
আশার কথা হলো এই, দেশটি এখন সত্যি সত্যি সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আইনের শাসন ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে বলতে গেলে পৃথিবীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। তারা পেছন ফিরে তাকাতে চায় না, তারা আর হুতু বা তুতসি পরিচয়ে নিজেদের পরিচিতি করাতে চায় না বরং তারা চায় রুয়ান্ডান হিসেবে দেশকে এগিয়ে নিতে, যার পথে তারা সত্যিই অনেক দুর এগিয়ে গেছে।

(৭ এপ্রিল, ২০১৭)