প্রবাসজীবনে দেখা হয় না সন্তানদের বেড়ে ওঠা

প্রতীকী ছবি। ছবি: লেখক
প্রতীকী ছবি। ছবি: লেখক

হায়রে প্রবাসজীবন! ভিন দেশে কত কিছু দেখার সুযোগ হয়। বিনিময়ে দেখা হয় না নিজ দেশের ও পরিবারের অনেক কিছু। এমনকি নিজের নাদুসনুদুস শিশুদের দিনে-দিনে বড় হয়ে ওঠাও দেখা হয় না। শিশুদের হাত ধরে বিকেলে মেঠো পথে বেড়ানো। ধান খেতের আইল ধরে হেঁটে-হেঁটে দেয়াং পাহাড়ে যাওয়া। শীতের খালি জমিতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে খেলা কিংবা উঠোনে ছেলের সঙ্গে ক্রিকেট-ফুটবল খেলা। গ্রামের টং দোকান থেকে এটা-সেটা খাওয়ার আবদার মেটানো। কখনো কখনো হাত ধরে বর্ণমালা শেখানো। নানান দুষ্টুমি দেখা। ছেলে শিশুকে পাঞ্জাবি-পায়জামা-টুপি পরিয়ে আঙুল ধরে জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়া। খাওয়ার সময় তাড়াতাড়ি খেয়ে বাচ্চাদের ফার্স্ট হওয়া দেখা। পারকি সমুদ্র সৈকতে বাচ্চাদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়া। সৈকতের বিস্তীর্ণ চালু বালুচরে খুশি মনে শিশুদের আনন্দ দেখা। দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফিসহ বাচ্চাদের আরও কত মজার সব কাণ্ড দেখা মিস হয়ে যায় প্রবাসীর।

প্রতীকী ছবি। ছবি: লেখক
প্রতীকী ছবি। ছবি: লেখক

প্রবাস থেকে দেশে বেড়াতে গেলে দুই-তিন মাস থেকে আবার প্রবাসে ফিরে এলে অনেকেই আবার দেশে যেতে পারেন দুই-তিন বছর পরে। কারও কারও পাঁচ-ছয় বছর বা এর বেশিও হয়ে যায়। এই সময়ের মধ্যে দেশে রেখে আসা আদরের শিশুরা বড় হয়ে যায়। এক বছরের বাচ্চা চার বছরের, চার বছরের বাচ্চা সাত বছর, সাত বছরের শিশু দশ বছরের হয়ে যায়। শিশুরা প্রাইমারি পেরিয়ে হাইস্কুলে পড়ুয়া হয়ে যায়। কারও কারও বেলায় সময়ের ব্যবধানটা কম-বেশি হয়। ছেলে-মেয়ে, আদরের ভাতিজা-ভাতিজি, ভাগনে-ভাগনিদের সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে নানভাবে বেড়ে ওঠা দেখা হয় না।

প্রতীকী ছবি। ছবি: লেখক
প্রতীকী ছবি। ছবি: লেখক

কোনো বছর শীতে দেশে গেলে বৈশাখে যাওয়া হয় না। বৈশাখে গেলে শরতে যাওয়া হয় না। শরতে গেলে বসন্তে যাওয়া হয় না। বসন্তে গেলে বর্ষায় যাওয়া হয় না। তাই কোনো বছর শীতের সকালে শিশুদের সঙ্গে রোদ পোহানো হলে, সে বছর হয়তো আর বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে বৈশাখী মেলায় যাওয়া হয় না। বৈশাখে দেশে গেলে সে বছর হয়তো আর শরতের সকালে ফুটফুটে মেয়েটির শিউলি ফুলের মালা গাঁথা দেখা হয় না। শরতে দেশে গেলে সে বছর হয়তো আর শীতের খোলা মাঠে ছেলের সঙ্গে ক্রিকেট খেলা হয় না। শীতে দেশে গেলে সে বছর হয়তো আর চৈত্রের দাবদাহে বাচ্চার জন্য ভালো গেঞ্জি কেনা হয় না। ঈদুল ফিতরে আনন্দময় দিনে দেশে থাকলে সে বছর হয়তো আর বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে বাজারে গিয়ে কোরবানির গরু কেনার আনন্দজনক সময় উপভোগ করা হয় না।
হয়তো দেখা হয় না সন্তানের নাদুসনুদুস পায়ে প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিনগুলি। ক্লাসের বাইরে বাচ্চার জন্য দাঁড়িয়ে থাকাও হয় না। অভিভাবক হয়ে বাচ্চার স্কুলে নিয়মিত যাওয়া হয় না। নিজের হাতে ছেলেমেয়েদের তিন চাকার গাড়ি থেকে দুই চাকার বাই সাইকেল চালানো শেখানো হয় না। ওদের সাইকেল চালানো শেখার সময় আছাড় খেয়ে পড়ে ব্যথা পেলে আদর করে বলা হয় না, তুমি ব্যথা পাওনি, মাটি ব্যথা পেয়েছে, ওঠো, আবার চালাও—এভাবে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দেওয়া হয় না।
শীতে যদি শিশুরা প্রবাসী বাবা, চাচা বা মামার সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় জানতে চায়, আপনি বাড়িতে কখন আসবেন? জবাবে যদি বলা হয় বৈশাখে। বৈশাখে এসে তোমাকে মেলায় নিয়ে যাব। শিশুরা তখন থেকে কদিন পর পর বাড়ির বড়দের কাছে জানতে চায় বৈশাখ কখন আসবে। বৈশাখে যদি যাওয়া না হয়, তাহলে শিশুর প্রশ্নের জবাবে হয়তো বলতে হয় ঈদের সময় আসব। তোমার জন্য ঈদের শপিং করে নিয়ে যাব। তোমাকে নিয়ে ঈদে তোমার নানির বাড়ি, ফুফুর বাড়ি, খালার বাড়ি বেড়াতে যাব, শিশুপার্কে ঘুরতে যাব। ঈদে যেতে না পারলে কোরবানির কথা। কোরবানিতে যাওয়া না হলে শীতের কথা। আর শীতের দিনে না হলে ঘুরেফিরে আবার বৈশাখের কথা। নয় তো অমুকের বিয়ে-তমুকের বিয়ের সময়ে যাওয়ার কথা বলে শিশুদের এক ধরনের ফাঁকি দিয়ে যেতে হয়।
মোবাইলে কথা বলা সহজ হওয়ায় শিশুদের প্রথম বুলির আওয়াজ টেলিফোনে কিছুটা শোনা যায় হয়তো। নরম পায়ে প্রথম হাঁটতে শেখা ভিডিও কলে দেখাও যায়। ঘরের এ রুম থেকে ওই রুমে দৌড়ানো, ঘরের গলিতে দৌড়ানো, জিনিস ছুড়ে ফেলানো ভিডিও কলে দেখা যায়। তবে সামনাসামনি তা দেখার ও শোনার যে আনন্দময় ব্যাপার তা থেকে বঞ্চিত হন বেশির ভাগ প্রবাসী।
কর্মে ডুবে থাকতে থাকতে প্রবাসের দিনগুলি চলে যায়। দিন গিয়ে সপ্তাহ, সপ্তাহ গিয়ে মাস, মাস পেরিয়ে বছর। বছর গড়িয়ে কয়েক বছর কেটে যায় চোখের পলকে। বাড়িতে মিষ্টি মিষ্টি শিশুরা বড় হতে থাকে চোখের অদেখায়।
এই তো প্রবাসীর জীবন। মিস হয়ে যায় অনেক কিছুই। অন্যতম মিস ঘরের অতি আদরের খুবই প্রিয় তুলতুলে শিশুদের হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে বেড়ে ওঠা দেখা হয় না। এই মিস অনেক বড় একটা কষ্টের আমার মতো প্রতিটা প্রবাসীর জীবনে।
পরিচিত এক প্রবাসীর মুখে শুনেছি তার মেয়ের কথা। ক্লাস ফাইভে পড়া মেয়েটির এক সহপাঠী স্কুলের এক অনুষ্ঠানে বাবা-মার মধ্যে কে বেশি ভালোবাসেন সেটা বলতে গিয়ে বলেছিল—বাবাই বেশি আদর করেন, তাকে মজার মজার খাবার কিনে দেন, সুন্দর সুন্দর পোশাক এটা-সেটা কিনে দেন, বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যান, মজার মজার খাবার কিনে দেন।
সহপাঠীর কথাগুলো শুনে মেয়েটি বাড়িতে ফিরে তার মাকে বলে, মা আমি এ রকম কখনো কি বলতে পারব না। পরের বছর মেয়েটি ক্লাস সিক্সে পড়ে। একদিন সে তার মাকে বলে, ‘আল্লাহ আমাকে নিয়ে গেলে ভালো হতো, আমি না থাকলে তো এভাবে আব্বুকে মনে পড়ত না!

লেখক
লেখক

আরেকজন পরিচিত প্রবাসী বন্ধু তার ছেলের কথা বললেন। শীতের কয়েক মাস আগের কথা। ফোনে কথা বলার সময় ছেলে তাকে জিজ্ঞেস করে, আব্বু তুমি দেশে আসবে কবে? তিনি ছেলেকে বলেন শীতকালে যাওয়ার কথা। ছেলে শীতকাল কখন তা বুঝছিল না। তাই তিনি বলেন, কুয়াশার দিনে আসব। ছেলে কুয়াশার দিন পুরোপুরি না বুঝলেও বাবার কথা মেনে নিল। দিন-মাস গড়িয়ে কুয়াশা ঝরার দিন চলে এল। কিন্তু তিনি যেতে পারেননি। ছেলে ফোনে তার কাছে জানতে চাইল, আব্বু তুমি না বলেছিলে কুয়াশার দিনে আসবে? এখন তো কুয়াশা পড়ে। কই তুমি তো আসছ না? তখন তিনি বলেন, এবার না, আবার যখন কুয়াশা ঝরার দিন আসবে তখন আসব। এই বলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছোট্ট ছেলেটাকে ফাঁকি দেন প্রবাসী বাবা। দেশে যেতে মন চাইলেও সময় ও সুযোগ সব বরাবর না হলে যাওয়া যায় না। ইচ্ছে হলেই খেলা হয় না অতি আদরের শিশুর সঙ্গে।
আপনজন ছাড়া নিষ্ঠুর প্রবাসজীবনে কয়েক বছর কাটিয়ে প্রবাস থেকে দেশে বেড়াতে গেলে ঘরের ছোট ছোট শিশুগুলোর সঙ্গে কত আনন্দ করা হয়। শিশুদের মিষ্টি মিষ্টি পবিত্র মুখগুলো দেখলেই প্রাণ ভরে যায়। দূর প্রবাসে করে আসা কষ্টের কথা, স্বজনদের না দেখার কথা ভুলে যাওয়া যায় প্রিয় শিশুর হাসিখুশি মুখ দেখলে। ঘরের আদরের বাচ্চাদের সঙ্গে বাচ্চা হয়ে খেলা, দুষ্টুমি করা, হইচই করা কত মজার। বাচ্চাদের সঙ্গে খেলার সুখটাই আলাদা। দেশে বেড়াতে গিয়ে মাত্র মাস তিনেক এই সুখ-আনন্দ উপভোগ করে জীবিকার তাগিদে পুনরায় নিষ্ঠুর প্রবাসজীবনে ফিরে আসলেই বাচ্চাদের মিস করা শুরু হয়। মিস, মিস! পরিবারের শিশুদের খেলা-আনন্দ-হাসি-কান্না-টালবাহানা দেখা মিস হয়ে যায় প্রবাসীর।
এই আমি নিজেই মিস করছি ছেলেমেয়ের বেড়ে ওঠা। প্রতিদিনই ওরা নতুন কিছু শিখছে, নতুন নতুন কথা বলছে। ওদের চেহারা, শরীর সব দিনে-দিনে পরিবর্তন হচ্ছে। মাঝেমধ্যে ভিডিও কলে দেখা আর টুকটাক কথা বলা, ওদের মুখে ছড়া শোনা এতটুকুই হয়। বাকি সবই মিস!