হাওরের কৃষক ছালেম মিয়া

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

দেহাতি, ছাপোষা ছালেম মিয়া বর্গাচাষ করে পরিবার চালান। মাটির জীবনযাপন তার। জৌলুশহীন জীবন। জীবনকে রঙিন নাটকের মতো দেখেন না। দেখেন স্রেফ সাদা-কালো ছবির মতো। আগাগোড়াই অমায়িক ও মাটির মানুষ। তিনি মাটিতে লতিয়ে ওঠা সবুজ লতার গন্ধ ও আত্মার স্পর্শ পান। বুকের ভেতর কী এক অপার্থিব শক্তিতে বুঝতে পান অবলা প্রাণীর ভাষাও।

রাস্তায় সারাটা দিন তারস্বরে ঘেউ ঘেউ করতে থাকা নেড়ি কুকুরটাও তার পায়ের শব্দে কুঁইকুঁই স্বরে মাথা নিচু করে দৌড়ে আসে। তারপর বাধ্য ছেলের মতো লেজ নাড়তে নাড়তে তার পিছু নেয়। সারা দিন না খেয়ে থাকা ক্ষুধাতুর বিড়ালের বাচ্চাটা তার কণ্ঠ শুনে গুটিসুটি মেরে বসে পড়ে তার পায়ের কাছে। দড়ি ছিঁড়ে তেড়েফুঁড়ে মারতে আসা তার সাদা-কালো দশাসই ষাঁড়টা তাকে সামনে পেয়ে হয়ে যায় আদুরে বিড়াল ছানা। থলথলে গলাটা বাড়িয়ে দেয় তার দিকে। ছালেম মিয়া হাত বোলান ষাঁড়ের ঘাড়, পিঠ ও গলায়। তার হাত ভরা মায়া ও মমতা!
কাজপাগল এই মানুষটা প্রতিদিন কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে বেরিয়ে যান হাওরের ধান খেতের দিকে কোচ ভর্তি চাল ভাজা নিয়ে। আর ফিরে আসেন কোচ ভর্তি কই মাছ ও সূর্য মাথায় নিয়ে।
পড়ন্ত বিকেলের দিকে ছালেম মিয়া ব্যস্ত হয়ে পড়েন স্বজন সেবায়। কেরানি হাট থেকে এনে দিতে হবে হাফিজ চাচার লইট্টা মাছটা, পাশের বাড়ির সদ্য হওয়া বাবুটার জন্য ডানো পাউডার দুধ আর ছৈয়দ্যা দাদির রং চায়ের সঙ্গে খাওয়ার জন্য পুদিনা পাতা।
আশপাশের সবার ফাই ফরমাশ পূরণ করতে পারাতেই যেন তার রাজ্যের সুখ। তার ঝাপসা কাচের চশমাটার নিচে খুশিতে চিকচিক করতে থাকে উজ্জ্বল দুটি চোখ। সব মিলে দৃশ্যপটে মাঝবয়সী এক পূর্ণ সুখী মানুষ।
এ রকম সুখী মানুষটার হঠাৎ দিনরাত সমান হয়ে গেছে। রাতের ঘুম নাই হয়ে গেছে চিন্তায়। হাওরের বিষাক্ত পানিতে তলিয়ে যাওয়া ধান খেতগুলোই ছিল তার পরিবারের ডালভাত জোগানোর একমাত্র সম্বল।
পাঁচ বছর মেয়াদি লিখিত চুক্তির সরকারি নিয়ম থাকলেও এই বর্গা আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় যুগ যুগ ধরে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন বর্গা কৃষক ছালেম মিয়া। আবাদ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ধান কাটা, মাড়াই পর্যন্ত সবকিছুর ব্যয়ভার বহন করতে হয় চড়া সুদের টাকায়।
ছালেম মিয়া ভালো করেই জানেন, ঘাম ঝরানো উৎপাদিত ধানের ওপর অনায়াসে অর্ধেক ভাগ বসানো সুবিধাবাদী জমির মালিক তলিয়ে যাওয়ার ক্ষয়ক্ষতির দিকে ফিরেও তাকাবেন না একটু। অন্যদিকে মহাজনের চড়া সুদে ঋণের বেড়াজালে আটকা ছালেম মিয়া চোখে অন্ধকার দেখেন। মাথায় কিলবিল করতে থাকে হাজারো টেনশন!
ছালেম মিয়া তার একমাত্র ছেলেটার মতিগতি বুঝে উঠতে পারেন না। ধ্যাবড়া ছেলেটা খাচ্ছে দাচ্ছে, তেলে ভেজা চুল পরিপাটি করে ঘুরে বেড়াচ্ছে! কোনো চিন্তা নাই! সারা দিন পড়ে থাকে মোবাইল নিয়ে। ছেলেটার সঙ্গে জরুরি কিছু কথা বলা প্রয়োজন।
ছালেম মিয়া ছেলের ঘরে ঢোকেন সশব্দে। তার দিকে ছেলের কোনো খেয়ালই নেই। ছেলে তার ঘরে চেয়ারে বসে মোবাইল হাতে নিয়ে ফেসবুকিং করছে। বাবার দিকে তার তাকানোর সময় কই!
—বাবারে, হাওরে তো পানিতে সব ডুইব্যা গেছে। সব ধানের জমি পানির নিচে। ক্যামনে যে এখন দিন চলব চিন্তা কইরা কূল পাই না।
জি অয় আব্বা।
—মন্নান মহাজনেত থিকা ডবল সুদে ঋণ নিয়া ফসল ফলাইছলাম। ৫০০ মণ ধান পাওনের কথা আছিল। সব শেষ আমার। এই ঋণ ক্যামনে শোধ দিতাম আর ক্যামনে আমরার পেট চলব? তোর পড়ার খরচ কইত থিকা যে দিমু ভাইব্য কূল পাই না!

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আইচ্ছা বাজান চিন্তা কইরো না। আমি একটু বাইরে যাইতাম অখন।
—কইছিলাম কি, তুই দুই-একটা ছাত্র পড়াইয়া তর পড়ার খরচ চালাইয়া লতি পারলে মন্দ হতো না!
বাবাকে সান্ত্বনা দেওয়া তো দূরের কথা। ছেলে ছালেম মিয়ার শেষ কথাটা শোনে কি শোনে না। ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ছালেম মিয়া চিন্তা করেন এই ছেলেকে দিয়া যে কি অইব?
বাইরে বের হয়ে তার ছেলে দেখে রিমঝিম বৃষ্টি। বৃষ্টির রোমান্টিকতায় সে ফেসবুকে পোস্ট দেয়—‘এমন বৃষ্টির দিনে কুটকুট প্রেম করার জন্য হলেও প্রেমিকা থাকা দরকার...।’ লাইক কমেন্টের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে ছেলে। এত লাইক কমেন্ট দেখে ছেলের সুখ মাখা চিকচিক করা চোখে ভেসে ওঠে সস্তা ভার্চ্যুয়াল সেলিব্রেটি হওয়ার স্বপ্ন।
অন্যদিকে ছালেম মিয়া বৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে আরও বেশি চিন্তায় পড়ে যান। না জানি বাড়িঘর আবার পানিতে ডুবে যায়। এমপি আসার খবর পেয়ে কিছু একটা পাওয়ার আশায় ছালেম মিয়া রওনা দেয় হাওরের দিকে। গিয়ে দেখেন এমপি সাহেব এসেছেন হাওর পরিদর্শন করতে। চারদিকে লোকে লোকারণ্য! তার মতো শত শত লোক গিজগিজ করছে ওই জায়গায়!
মানুষের ভিড় ঠেলে ছালেম মিয়া এমপি সাহেবের কাছাকাছি যাওয়ার জোর চেষ্টা চালায়। এমপি সাহেবকে ঘিরে আছে সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা কয়েকজন। সে তাদের বোঝাতে চেষ্টা করে, এমপি সাহেব তার পরিচিত। গত ইলেকশনের সময় এই হাওরের কাদাভরা ধানি জমিতে নেমে এমপি সাহেব তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, আমাকে ভোট দিয়ে এমপি বানালেই কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে সরাসরি বলবেন।
কিন্তু সিকিউরিটির লোকজন ছালেম মিয়াকে এমপির কাছে যেতে দেয় না! ছালেম মিয়া চিৎকার করে এমপি সাহেবকে ডাক দেয়। এমপি সাহেব খেয়াল করেন না! সে জোর করে এমপি সাহেবের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে। তাকে থামাতে না পেরে সিকিউরিটির একজন জোরে ধাক্কা দেয়। ছালেম মিয়ার ভেঙে পড়া শরীর সে ধাক্কা সামলে উঠতে পারে না। পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একটা ইটের ওপর তার মাথা আছড়ে পড়ে। মাথার একপাশ থেঁতলে গিয়ে রক্ত ঝরছে। এমপি সাহেব দেখেও না দেখার ভান করেন। ঝাপসা হয়ে আসছে ছালেম মিয়ার চোখ। ঘোলাটে চোখে ছালেম মিয়া দেখে এমপি সাহেব হাওরের পানি দেখে রোমান্টিসিজমে আক্রান্ত হয়ে ছবি ও সেলফি তুলছেন। সঙ্গে থাকা সাংবাদিকদের গালভরা হাসি দিয়ে বলছেন পত্রিকায় ছবি ও পরিদর্শন সংবাদ যেন ভালো করে আসে...।

*লেখক সৌদি আরবের জেদ্দাপ্রবাসী।