কেনিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের বৈশাখ উদ্যাপন

বৈশাখ উদ্‌যাপনের একটি দৃশ্য
বৈশাখ উদ্‌যাপনের একটি দৃশ্য

আফ্রিকা মহাদেশের হাতেগোনা যে কয়েকটি দেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি বাস করেন তার মধ্যে কেনিয়া অন্যতম। বাংলাদেশে পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়া পরিচিত মূলত ক্রিকেটের জন্য। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে আকরাম খান আর নাইমুর রহমান দুর্জয়দের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতো স্টিভ টিকোলো আর মরিশ ওদুম্বেদের। কিন্তু ক্রিকেটের পরিচিতি ছাপিয়ে এখন পূর্ব আফ্রিকার আইটি, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক হাব হিসেবে পরিচিত কেনিয়া আফ্রিকার অন্যতম ভূরাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র।

বৈশাখ উদ্‌যাপনের একটি দৃশ্য
বৈশাখ উদ্‌যাপনের একটি দৃশ্য

আফ্রিকা মহাদেশ সম্পর্কে যে গৎবাঁধা ধারণা আর গতানুগতিক অভিমত আমাদের—যেমন শুষ্ক আর গরম আবহাওয়া, জঙ্গলময় বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ স্থান। যেখানে খরা, দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ আর জাতিগত দাঙ্গার সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংগ্রামে ক্লান্ত মানুষ। এই সব চিত্রের সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম কেনিয়া। ভারত মহাসাগরের তীরে অবস্থিত মনোরম আর বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর কেনিয়া একদিকে যেমন অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধির পথে থাকা এক দেশ; অপরদিকে তেমনি ৪২টি ভিন্ন জাতি-সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে এটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের এক অপূর্ব সম্মিলন। বিশ্বের অন্যতম সবুজ নগরী হিসেবে স্বীকৃত রাজধানী নাইরোবিসহ সমগ্র দেশটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বন্যপ্রাণী সাফারির জন্য বিশ্ব পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্যস্থল।

বৈশাখ উদ্‌যাপনের একটি দৃশ্য
বৈশাখ উদ্‌যাপনের একটি দৃশ্য

দেশটি আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় চার গুন বড় হলেও জনসংখ্যা পাঁচ কোটিরও কম। বিশ্বব্যাংকের সূচকে ২০১৪ সালে নিম্ন মধ্যআয়ের দেশে উন্নীত এ দেশটি আর্থসামাজিক অবস্থানে প্রায় বাংলাদেশের সমপর্যায়ে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, মোবাইল ফোন ও নেটওয়ার্ক কোম্পানি, স্কয়ার বাংলাদেশ, আশা ইন্টারন্যাশনাল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানসহ চিকিৎসা, প্রকৌশল, ব্যাংক, ব্যবসা ও কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় শ দুয়েক প্রবাসী বাংলাদেশি এ দেশের রাজধানী নাইরোবি ও দক্ষিণ পূর্ব সমুদ্র উপকূলবর্তী মোম্বাসা শহরে বসবাস করেন। কেনিয়াসহ পূর্ব আফ্রিকার অন্যান্য দেশের সঙ্গে বৈদেশিক সম্পর্ক বজায় রাখতে নাইরোবিতে বাংলাদেশের হাইকমিশন স্থাপন করা হয়েছে সেই ১৯৭৮ সালে। অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি হাইকমিশন স্থানীয় বাংলাদেশিদের বিভিন্ন সেবা প্রদানসহ জাতীয় ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য দিবস নিয়মিত পালন করে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের উদ্যোগে এবং কেনিয়ায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণে গত ৩০ এপ্রিল রোববার বাংলাদেশ হাইকমিশন চত্বরে পালিত হয়েছে বাংলা নববর্ষ ১৪২৪।

বৈশাখ উদ্‌যাপনের একটি দৃশ্য
বৈশাখ উদ্‌যাপনের একটি দৃশ্য

কেনিয়ায় বাংলাদেশের নবনিযুক্ত হাইকমিশনার মেজর জেনারেল আবুল কালাম মোহাম্মদ হ‌ুমায়ূন কবির ও তার স্ত্রী তানজিনা কবিরের সার্বিক নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে এবারের নববর্ষ উদ্‌যাপন ছিল ব্যাপক পরিসর আর বর্ণাঢ্য আয়োজনে। পয়লা বৈশাখের নির্ধারিত ১৪ এপ্রিল তারিখে কেনিয়ায় সরকারি ছুটি থাকায় এবং সকলের উপস্থিতির সুবিধার্থে নববর্ষ উদ্‌যাপন কিছুটা বিলম্বিত হয়। বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ দেশে-বিদেশে সবখানে সব সময়ই বাঙালিদের জন্য অত্যন্ত আনন্দময় ও আবেগপূর্ণ একটি দিন। বিদেশর মাটিতে বাঙালিয়ানা প্রকাশ ও প্রদর্শনের অন্যতম উৎসব। তাই কিছুটা দেরিতে অনুষ্ঠিত হলেও কমিউনিটির অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত আনন্দঘন এবং স্বতঃস্ফূর্ত।

বৈশাখ উদ্‌যাপনের একটি দৃশ্য
বৈশাখ উদ্‌যাপনের একটি দৃশ্য

মঙ্গল শোভাযাত্রা দিয়ে দিনের কর্মসূচির শুরু হয়। শোভাযাত্রায় বড়রা সবাই বিভিন্ন রকম রং-বেরঙের প্লাকার্ড নিয়ে আর লাল-সাদা শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে অংশ নেন। শিশুরাও এতে অংশ নেয়। বাঙালি কমিউনিটি ও হাইকমিশনের উদ্যোগে নানা রকম খাবার-দাবারের আয়োজন করা হয়। বাতাসা, চটপটি, ফুচকা থেকে শুরু করে তেঁতুল আর আখের রস কিছুই বাদ যায়নি এই তালিকা থেকে। ছিল পান্তা, বিভিন্ন রকমের ভর্তা আর মাছ ভাজা। ছিল পিঠা, পায়েস, মিষ্টি ও দইও। শিশুদের জন্য ছিল যেমন খুশি তেমন সাজার আয়োজন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিল ছয় মাস বয়সী ছোট্ট তাজিন। দাদির কোলে চড়ে সে বোষ্টমি সেজেছিল। বিভিন্ন বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্য ছিল বাংলা লেখার প্রতিযোগিতা। আমাদের প্রবাসী ছেলেমেয়েরা যাতে বাংলা ভুলে না যায় সে জন্য হাইকমিশনের পক্ষ থেকে শিগগিরই একটা বাংলা চর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কথা জোরেশোরে আলোচনা করা হয়েছে। আরও ছিল বড় ও ছোটদের জন্য দেশীয় খেলাধুলার আয়োজন। বড়দের মোরগ লড়াইও বেশ জমেছিল।

বৈশাখ উদ্‌যাপনের একটি দৃশ্য
বৈশাখ উদ্‌যাপনের একটি দৃশ্য

এরপর ছিল মনোজ্ঞ বৈশাখী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সুদীপ্তর বেহালা আর আরিয়ানের কিবোর্ডের সুরে নাইরোবির বাঙালি শিল্পীদের কণ্ঠে ‘এসো হে বৈশাখ’ গান দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। শাহ আবদুল করিমের গান, শিশু ও বড়দের কবিতা আবৃত্তি, পিয়ানোর সুরে ‘মেলায় যাইরে’ গান, নৃত্য, এমনকি বাঁশির মন মাতানো সুরও ছিল আয়োজনের মধ্যে। দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করের প্রবাসী বাংলাদেশি মুস্তাফা গোলাম, রুপা ইকবাল আর ফারজানা আফরিন।

বৈশাখ উদ্‌যাপনের একটি দৃশ্য
বৈশাখ উদ্‌যাপনের একটি দৃশ্য

দুপুরে জম্পেশ খাবারের আয়োজন করেছিল বাঙালি কমিউনিটি আর হাইকমিশনের রন্ধন শিল্পীরা। মজার মজার খাবারের আয়োজনে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমরা গুটিকতক বাঙালি যেন বাংলাদেশে চলে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান শেষ হয় পুরস্কার বিতরণ আর হাইকমিশনার মহোদয়ের ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে। ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ গানটি গাইতে গাইতে সারা দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। বিদেশের মাটিতে নানা কর্মব্যস্ততার মধ্যেও প্রবাসী আর দূতাবাসের স্বল্প লোকবলের সহযোগিতায় এত বড় পরিসরে আয়োজিত পয়লা বৈশাখের সুষ্ঠু ও সফল পরিসমাপ্তি সকলের কাছে প্রশংসিত হয়।

বৈশাখ উদ্‌যাপনের একটি দৃশ্য
বৈশাখ উদ্‌যাপনের একটি দৃশ্য