ইরানের শবে বরাত উৎসব

বর্ণিল সাজে সজ্জিত অলিগলি
বর্ণিল সাজে সজ্জিত অলিগলি

বাংলাদেশে বেশ ঘটা করে সারা রাত ধরে ইবাদত-বন্দেগি ও রুটি হালুয়াসহ বিভিন্ন ধরনের মিষ্টিজাত খাবার তৈরি এবং সেগুলো গরিব-দুঃখীদের মাঝে বিতরণ করে ১৫ শাবান রাতে পবিত্র শবে বরাত বা ভাগ্য রজনী পালিত হয়। ইরানের বেশির ভাগ অঞ্চলেও আরবি শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাতে ‘নিমে শাবান’ (অর্থাৎ আরবি শাবান মাসের অর্ধেক) নামে এই রজনীটি পালিত হয়। ইরানে মূলত এই রজনীটি শিয়া মাজহাবের দ্বাদশ ইমাম হজরত ইমাম মাহদির জন্মদিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। সাধারণত কয়েক রাত আগে থেকেই বিভিন্ন ধরনের রীতিনীতি ও আদব-কায়দা সহকারে এই রাতটি পালিত হয়।

তবে প্রাচীন ইরানের শবে বরাত সম্পর্কে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে লিখিত বেশ কিছু লেখক ও কবির উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো। অতীতে লিখিত রচনাবলীতে এই রাতটিকে শাবে বারাত, লাইলাতুল বারাত, লাইলাতুল চেক (সেক), শাবে নোসখে, শাবে ফারক ও শাবে আরজ নামে স্মরণ উল্লেখ করা হয়েছে।
আবু রায়হান আল বেরুনি লিখেছেন: ‘১৫তম শাবানের রাত হচ্ছে মহত্তম রাত এবং এটিকে শাবে বারাত বলা হয়। সম্ভবত ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে পুণ্য সংগ্রহ করে নরকের আগুন থেকে বেঁচে থাকার জন্য ও ভাগ্যকে সুপ্রসন্ন করার প্রক্রিয়াকে শাবে বারাত বলে।’

পথিকদের জন্য শরবত বিতরণ করা হচ্ছে
পথিকদের জন্য শরবত বিতরণ করা হচ্ছে

পঞ্চম হিজরির ফারসি গদ্য লেখক গারদিজি এই রাতের নামকরণ সম্পর্কে কিছুটা ভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন: ‘এই দিনের রাতটি শাবে বারাত নামে পরিচিত। ভাগ্যগুলো লওহে মাহফুজে সংরক্ষিত আছে এবং মহান প্রভু সেখানে অবস্থান করছেন। এই রাতে মহান প্রভু লওহে মাহফুজ থেকে আকাশে নেমে আসেন। সেখান থেকেই দুনিয়াবাসির জন্য মহান প্রভুর নির্দেশ নিয়ে আসা হয়। তাই এই বিশেষ রাতকে লাইলাতুল কদর আস সাকও বলা হয়।’
কিছু কিছু গবেষক শবে বরাতের উৎসবকে ইসলামপূর্ব প্রাচীন ইরানের ফারভারদেগান উৎসবের পরিবর্তিত রূপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ ছাড়া বর্তমান ইরানে সবচেয়ে প্রচলিত মতামত হচ্ছে, এই রাতে ইমাম মাহদি জন্মগ্রহণ করেছেন। এ কারণেই ইরানের সর্বত্র উৎসবটি পালিত হয়। এই রাতে অলি-গলি, রাস্তা-ঘাট সর্বত্র আলোক সাজসজ্জা করা হয়। আতশবাজি উৎসব দেখা যায়। ছাত্রাবাসসমূহে আনন্দ উৎসব পালিত হয়। বিজয় তোরণ তৈরি করা হয়। মিষ্টি ও শরবত বিতরণ করা হয়। রাস্তায়-রাস্তায় ইমাম মাহদির আগমন নিয়ে গান গাওয়া ও শুভেচ্ছা জানানো হয়। এ ছাড়া ১৫ শাবান ইরানি আচার প্রথা অনুযায়ী দিন-রাত মিলাদ ও দোয়া-মাহফিলের আয়োজন করা হয়। পথ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে কেউ হয়তো আপনাকে বাড়িয়ে দেবে শরবতের পেয়ালা, চা, কেক, ফলমূল ও চকলেটসহ হরেকরকম মিষ্টান্ন দ্রব্য।

ইমাম মেহেদির জন্মদিন বা নিমে শাবান উপলক্ষে সজ্জিত ইরানের পথঘাট
ইমাম মেহেদির জন্মদিন বা নিমে শাবান উপলক্ষে সজ্জিত ইরানের পথঘাট

কুর্দিস্তান প্রদেশের সাগজ অঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে, এই আনন্দের ভাগ্য রজনীতে মহান আল্লাহর দরবারের ঘনিষ্ঠ ও দলিল-দস্তাবেজ সংরক্ষক ফেরেশতা মিকাইল মানবজাতির আয়-রোজগার ও এক বছরের রিজিক লিখে থাকেন। এই বিশ্বাস থেকে লোকজন এই রাতে ভালো ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার এবং পছন্দসই ফল খেতে ভালোবাসেন। এর উদ্দেশ্য হলো আগামী বছরের প্রতিটি দিন যেন একইভাবে ভালো ভালো খাবার ও পছন্দসই ফল খেতে পারেন। এ ছাড়া তারা এই রাতে প্রচুর রুজি রোজগারের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেন।
ইরানের বিভিন্ন প্রদেশে এখনো অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ও ব্যাপক উৎসাহ সহকারে পালিত হয় শবে বরাত। বিশেষ করে দান-খয়রাত, বিভিন্ন প্রকারের রুটি তৈরি, সুস্বাদু মিষ্টান্ন সামানু তৈরি, মোরগ বা টার্কি উৎসর্গ করা ও বিভিন্ন ধরনের হালুয়া তৈরি এই রাতের অন্যতম আচার-আচরণ। এই রাতে দলবদ্ধভাবে বিশেষ কবিতা ও গান গাওয়াটাও এখানকার মানুষের অন্যতম বিনোদন হিসেবে চিহ্নিত। এমনি একটি ফারসি কবিতার বাংলা রূপ তুলে ধরছি:

এই রাত উৎসর্গের রাত মৃত ব্যক্তিদের ক্ষমার রাত
এই রাত ভাগ্যের রাত রাঁধো হালুয়া, আর বানাও নাবাত
এমন উৎসর্গের রাতে মাহদি রয়েছে আমাদের মোনাজাতে
এমন জন্মদিনের রাতে যেন সকলের আনন্দ আর উৎফুল্লে কাটে।

ইরানিরা পরিবারের সব সদস্য মিলে এভাবেই ইমাম মেহেদির জন্মোৎসব পালন করে থাকেন
ইরানিরা পরিবারের সব সদস্য মিলে এভাবেই ইমাম মেহেদির জন্মোৎসব পালন করে থাকেন

এই দিনে পারস্য দেশের মানুষের আতিথেয়তা আপনাকে মুগ্ধ করবে। কখনো কখনো আপনি ফিরে যাবেন বাংলাদেশের আনাচকানাচে শবে বরাত উৎসবের আড়ম্বরপূর্ণ ও জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে। যেখানে কিছুটা হলেও ইরান-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক অভিন্নতার দেখা মিলবে।

*লেখক সহকারী অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে পিএইচডি গবেষক, তারবিয়্যাত মোদাররেস বিশ্ববিদ্যালয়, তেহরান, ইরান।