ফেরো একবার স্বপ্নের কৈশোর

শিল্পী আরহাম উল হকের ভাস্কর্য ‘দাঁড়িয়ে আছো’। প্রতীকী ছবি
শিল্পী আরহাম উল হকের ভাস্কর্য ‘দাঁড়িয়ে আছো’। প্রতীকী ছবি

সেদিন খুব জমে যাওয়া এক আড্ডায় হঠাৎ প্রশ্ন উঠল, কার জীবনের কোন সময়টা ছিল শ্রেষ্ঠ? বেশির ভাগই বলল শৈশব। বয়স ৬-৭ কিংবা আর দু-এক বেশি। এই সময়ে যা ইচ্ছা তাই করা যেত! পড়ালেখার চাপ থাকত না। নভেম্বর-ডিসেম্বর আসলেই হই হই করে নানিবাড়ি-দাদিবাড়ি যাওয়া যেতো। সত্যি কী ভাবনাহীন ছিল সে দিনগুলো! আড্ডার সবাই বোধ হয়, একবার করে চোখ বুলিয়ে এলাম আমাদের সেই বয়সটায়।
এরপর বাকিরা বলল, তাদের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল ভার্সিটি লাইফ। কী উচ্ছ্বাস, কী আনন্দ আর ভরপুর তারুণ্যে গোঁজা ছিল দিনগুলো! যখন ইচ্ছা তখন হুটহাট বন্ধুরা মিলে বেরিয়ে পড়া (কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা টাইপ মন নিয়ে)। ফাঁকিবাজির উদ্দেশ্যে ইনকোর্স আসলেই শিক্ষকদের রুমে রুমে গিয়ে পরীক্ষা পেছানোর ধরনা দেওয়া। অতঃপর ডিপার্টমেন্টের জোরালো অবস্থানে পরীক্ষা অপরিবর্তিত থাকায় (সাবজেক্টের গোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে) সবাই মিলে লেকচার জোগাড় করা এবং এ জীবনের কোনো মানে হয় না বলতে বলতে আবার একযোগে লাইব্রেরিতে ঢোকা। আহ কী রুপালি সেই দিনগুলো; যেন এক সোনালি প্রজাপতির ডানায় ভর দিয়ে হুট করে এসে চলে গেল দূরে, বহুদূরে...!
এবার সবাই আমাকে ধরল, শুধু আমিই নাকি বাকি? তখনো বলিনি প্রিয় সময়টা। বিপদ ফিল করলাম, কারণ একজনও আর অবশিষ্ট নেই। এদিকে আমার প্রিয় সময় যে দেখলাম না কারও প্রিয়। এ ক্ষেত্রে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। কিন্তু লাভ হলো না। শেষে বলেই ফেললাম কৈশোর। কৈশোরের ১৩ থেকে ১৬ আমার খুব খুব খুব প্রিয়। মানুষ যদিও বর্তমান সময়টা নিয়ে হ্যাপি থাকে না; তবু আমার এখনো মনে আছে, স্বপ্নে-স্বপ্নময় সে দিনগুলোয় থাকাকালেও তা ছিল আমার প্রিয়।...কী অদ্ভুত! সবাই ক্ষেপে গেল, ভাবল ঠাট্টা করছি। সবার মতে ওটাই সবচেয়ে প্রবলেমেটিক সময়। অতি উত্সাহী একজন বলে বসল ওই বয়সে ভালো লাগার মতো একটাই ব্যাপার ছিল; আর তা হচ্ছে প্রচুর প্রেম-প্রস্তাব এবং প্রেম-পত্র পাওয়া!

মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। রেগে বললাম, ওটাই ছিল ওই বয়সের সবচেয়ে বিরক্তিকর অংশ। একটা প্রেমপত্র কিংবা আমার সঙ্গে কথা বলতে চাওয়া অপরিচিতের একটা ফোন কল মানেই নেক্সট দুই সপ্তাহের জন্য আম্মার নজরবন্দী হওয়া। যা ছিল চরম অসহ্য। প্রেম-প্রস্তাব পাওয়াই যদি মজার ব্যাপার হতো, তাহলে তো বর্তমান সময়টাই ভালো। ফেসবুকের (অ) কল্যাণে এই বুড়ো বয়সেও তো অপরিচিত কিছু বেকুব মানুষের কাছ থেকে সে প্রস্তাব পাই, তাতে ভালো লাগার কি আছে? ডিলিটের মতো বিরক্তিকর প্রসেসের ভেতর দিয়ে যাওয়া ছাড়া?
কিছুই বললাম না আর! প্রেম অফার পাওয়াটাই ওই বয়সের একমাত্র আকর্ষণীয় দিক যাদের কাছে, তারা কি হাসাহাসি করবে না আমার সে সময়ের সার্বক্ষণিক বিপ্লবী/প্রতিবাদী ফিলিংসের কথা শুনলে? হাসাহাসি করলেও আমার খুব বলতে ইচ্ছা করছিল, কী অসম্ভব রঙিন সব কল্পনায় তখন ভাসতাম। কীভাবে প্রথমে আমার শহর সাতক্ষীরা, তারপর তার পাশের শহর, তারপর তার পাশেরটাও কীভাবে বদলে যাবে...ধীরে ধীরে কীভাবে গোটা বাংলাদেশটাই কেমন অন্যরকম হয়ে যাবে...। আসলে তখন মাত্র শুরু করেছিলাম পড়তে দারুণ সব সমাজ/পৃথিবী বদলে দেওয়ার স্বপ্ন-দেখানো বই। প্রতিদিন নতুন নতুন প্ল্যান করতাম এবং বিশ্বাস করতাম সেভাবেই হবে সবকিছু। কী শক্ত ছিল সে বিশ্বাস। অথচ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্বপ্নগুলো ফিকে হলো। বাধা-বিভেদ-বিপত্তিহীন এক সমাজ-চিন্তা' জেনে গেলাম কঠিন, আর সে কঠিনের পথ থেকে একটু করে সরতেই বাস্তবের ম্যাড়মেড়ে দিনের শুরু।
যেখানে একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বপ্নবতী কোনো মেয়ের মেয়ে-মানুষ নয় পূর্ণাঙ্গ এক মানুষ হিসেবে সামনে এগোনোর লড়াইই বড় জটিল, সেখানে আমরা সবাই রাজার দিন সৃষ্টির ইচ্ছা কল্পনার সাদা ঘোড়া ছাড়া বোধ হয় আর কিছুই নয়। কী জানি! জানব কি? আমার জানাশোনা সবেতেই কম। শুধু এটুকু জানি কৈশোরের ওই ১৩ থেকে ১৬ বয়সটার কথা বলতে ইচ্ছা করে। সত্যি খুব বলতে ইচ্ছা করে। বলতে বলতে ওই সময়ে ডুবে যেতে ইচ্ছা করে। ডুবে থাকতে ইচ্ছা করে এবং আর না ফিরতে ইচ্ছা করে!