বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে মূসক

মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে এই মূল্য সংযোজন কর ভ্যাট নামেই পরিচিত। ভ্যাট (ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স) একটি হিসাবনির্ভর আধুনিক কর। সাধারণত কোনো পণ্য বা সেবার ভোক্তার ওপর এই কর আরোপিত হয়।

কোনো কোনো দেশে এটাকে গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স (জিএসটি) বলা হয়ে থাকে। যখন একটি পণ্য আমদানি করা হয় বা কারখানায় উৎপাদিত হয়, সেখান থেকে খুচরা বিক্রি পর্যন্ত প্রতি ধাপে পণ্যটির ওপর যে মূল্য সংযোজিত হয়, সেই মূল্যের ওপর মূসক বসে। তবে এই কর আমদানি বা উৎপাদন থেকে খুচরা পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে আরোপ বা আদায় করা হলেও চূড়ান্তভাবে কেবলমাত্র পণ্যটির বা সেবার ভোক্তাকেই বহন করতে হয়। সেই ভোক্তারা হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতা।
সে জন্যে মূসক কখনই কোনো ব্যবসায়ী বা বিক্রেতার দায় হিসেবে গণ্য হয় না। এটি শেষ পর্যন্ত ভোক্তারাই পরিশোধ করেন।
বিক্রেতা ব্যবসায়ী বা সেবাপ্রদানকারী সংস্থা সরকারের কাছে নিবন্ধিত হয়ে মূসক বা ভ্যাট নম্বর সংগ্রহ করে ভোক্তাদের কাছ হতে মূসক বা ভ্যাট আদায় করে সরকারের কাছে প্রেরণের আগ পর্যন্ত তা নিজেরদের কাছে রেখে দেন ট্রাস্ট ফান্ড হিসেবে।

লেখক
লেখক

তারপর ওই সব ব্যবসায়ীরা যখন নিজেদের ব্যবসায়ের মালামালের ক্রেতা হিসেবে বা কোনো ধরনের সেবা গ্রহণের কারণে যে পরিমাণ মূসক প্রদান করে থাকেন তা আদায়কৃত মূসকের সঙ্গে বিয়োগ করে নিট পরিমাণটা সরকারের রাজস্ব বিভাগে মাসিক, ত্রৈমাসিক বা বাৎসরিক অন্তর প্রেরণ করেন।
তাই দাখিলকৃত ব্যবসায়ীদের মূসক রিটার্নের নিট ট্যাক্স কখনো পজিটিভ হয় কখনো বা নেগেটিভ হয়। পজিটিভ হলে মূসক সরকারকে প্রদান করতে হয় আর নেগেটিভ হলে সরকারের কাছ হতে রিফান্ড বা ফেরত পান।

এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রায় ৮ লাখ মূসক নিবন্ধনকারী থাকলেও মূসক রিটার্ন দাখিল করেন মাত্র ৩২ হাজার জন। এই পরিসংখ্যানটি খুবই হতাশাজনক। বর্তমানে দেশে যে ভ্যাট চালু আছে তা প্যাকেজ ভ্যাট নামে পরিচিত।
নিবন্ধনকারীরা তাদের সারা বৎসরের বিক্রয়কৃত আয়ের ওপর থোক আকারে ভ্যাট প্রদান করে থাকেন। কিন্তু আগামী জুলাই থেকে নতুন মূসক আইনে নির্দিষ্ট ১৫ শতাংশ হারে মূসক আদায় করে এনবিআরের কাছে প্রেরণ করতে হবে।
আধুনিক বিশ্ব বাণিজ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সরকারের রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যে মূসক আইন তৈরি করা ও পণ্যের ওপর মূসক আরোপের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় অনেক আগে থেকেই। তাই আইএমএফ নতুন মূসক আইন করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে তাগিদ দেয় এবং সেই কাজ করার জন্য বর্ধিত ঋণ সহায়তার (ইসিএফ) আওতায় ২০১২ সালে প্রায় ১০০ কোটি ডলার ঋণ বাংলাদেশ সরকারকে প্রদান করে। পরে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা নিয়ে সরকার অতি সম্প্রতি নতুন মূসক আইন প্রণয়ন করেছেন। আগামী ১ জুলাই ২০১৭ থেকে বাংলাদেশে এই নতুন মূসক আইন কার্যকর হতে যাচ্ছে এবং সেখানে ১৫ শতাংশ হারে মূসক আরোপ করার কথা বলা হচ্ছে।
বাংলাদেশে এখন মূসক নিয়ে ব্যবসায়ী মহলে আলোচনা সমালোচনার সঙ্গে খুব ক্ষোভও প্রকাশ করা হচ্ছে। গত ৩০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই–এর সঙ্গে যৌথ পরামর্শক সভায় বক্তব্য রাখার সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বাহাস হয়। সেখানে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আন্দোলনের হুমকিও দেওয়া হয়। (প্রথম আলো, ১ মে ২০১৭)।
নতুন মূসক আইন ও হার নিয়ে ব্যবসায়ীরা এতটাই হতাশ ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত যে, তা প্রতিদিনকার পত্রিকা উলটালেই চোখে পড়ে। ঢাকার বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা মূসক রেয়াত বা হ্রাস করার দাবি একের পর এক করেই চলেছেন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের একটিই কথা আর তা হলো ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিলে ব্যবসায় আর কিছুই থাকে না।
কিন্তু ভ্যাট তো দিচ্ছেন ভোক্তারা। ব্যবসায়ীরা শুধু মাধ্যম হয়ে আদায় করে দেবেন। তাহলে সমস্যা কোথায় এমন প্রশ্ন করা হলে ব্যবসায়ীরা সাধারণ ভোক্তাদের কথা বিবেচনা করে তাদেরই পক্ষ হয়ে এসব কথা সরকারের কাছে পাড়ছেন বলে জানান।
শুধু নতুন মূসক হার নিয়ে নয় বরং মূসক আইন নিয়ে সবচেয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কথা জানিয়েছেন ঢাকা চেম্বারের সদস্যরা। তারা বলছেন মূসক আইনের কিছু ধারা ন্যায় বিচারের পরিপন্থী (প্রথম আলো, ১ মে ২০১৭)। নতুন আইনে রাজস্ব কর্মকর্তাদের নাকি সীমাহীন বিচারিক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। তারা বলছেন, সে ক্ষমতা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল এবং প্রচলিত আইনে ন্যায় বিচারের পরিপন্থী।
কিন্তু নতুন মূসক আইনের ৮৩তম অনুচ্ছেদ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রাজস্ব কর্মকর্তাদের বিচারিক ক্ষমতা নয় বরং তদারকি ও নিরীক্ষা করার পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। একজন সহকারী কমিশনারকে যেকোনো ব্যবসার হিসাবপত্র, বুকস অ্যান্ড রেকর্ডস ও ব্যাংক হিসাবের লেনদেন অনুসন্ধান করার যে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে সেটা যথার্থই।
এটা কোনোভাবেই ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে পড়ে না। কারণ এই আইন যথাযথ আবগারি শুল্ক আইনের প্রেক্ষিতে সরকার কর্তৃক প্রণয়ন করা হয়েছে এবং সংসদ থেকে তা অনুমোদন নিয়ে আইন করা হয়েছে। তাই মূসক আইনের এই ধারা কোনোভাবেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।
কর আইনের আওতায় বুকস অ্যান্ড রেকর্ডস ও ব্যাংক ডিপোজিট বিশ্লেষণ করা এবং এ ধরনের ব্যবস্থা পৃথিবীর সব দেশেই আছে। কর কর্মকর্তা বা নিরীক্ষকেরা করদাতাদের বাড়িতে বা গাড়িতে অনুসন্ধান করতে যাবেন কেন। কোনো কোনো ব্যবসায়ীরা মূসক দিচ্ছেন না তা অনুসন্ধান করা কর কর্মকর্তাদের কাজ হলেও তারা সাধারণত সেটা করবেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে।
যে লোকেশনে ব্যবসার হিসাব ও নথিপত্র থাকে বা যে ঠিকানায় বুকস অ্যান্ড রেকর্ডস ভেরিফিকেশনের জন্য নিয়ম মোতাবেক রাখার কথা সেখানে যাবেন এবং নিরীক্ষণ করবেন। সেটাও তারা করবেন করদাতাকে আগাম জানান দিয়ে, নোটিশ বা চিঠি ইস্যু করে। প্রায় সকল দেশের কর কর্মকর্তা বা অডিটরেরা এভাবেই করদাতাদের ব্যবসার অ্যাকচুয়াল ফিজিক্যাল লোকেশন, দাখিল করা মূসক রিটার্নস, ক্যাশ বুক বা ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার, বুকস অ্যান্ড রেকর্ডস ইত্যাদি নিরীক্ষা করে থাকেন।
মূসক আইনের অনুচ্ছেদ ৯০–এর কথা উল্লেখ করে ঢাকা চেম্বার বলেছে যে, মূসক ফাঁকি দিলে বা মূসক দিতে দেরি হলে অথবা দৃশ্যমান স্থানে মূসকের হিসাব না রাখলে রাজস্ব কর্মকর্তার যদি সন্দেহ হয় তাহলে তিনি প্রতি বারের জন্যই ১০ হাজার টাকা জরিমানা করবেন।
রাজস্ব কর্মকর্তা শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়েই এ কাজ করবেন না। সেটা প্রমাণিত হলে তবেই করবেন। করদাতারা যদি ইচ্ছা করে বা গাফিলতি করে মূসক ফাঁকি দেয় বা দেরি করে জমা দেয় তাহলে তো জরিমানা গুনতেই হবে। কারণ আপনি নিবন্ধিত মূসক আদায়কারী হয়েও সরকারের মূসক আইন মানছেন না। আর যেকোনো আইন না মানা অপরাধ। মূসক আইনও ঠিক অন্যান্য সকল প্রচলিত আইনের মতোই।
কোনো আইনকেই হালকাভাবে নিয়ে তা অমান্য করা যাবে না। তা ছাড়া আপনার সংগৃহীত মূসক ভোক্তাদের কাছ থেকে আদায় করেছেন সরকারকে দেবেন বলে। সে টাকা আপনি কোনোভাবেই নিজের পুঁজির সঙ্গে মেলাতে পারবেন না। কারণ এটা আপনার টাকা নয়। আপনি অনেকটা ট্রাস্টি হিসেবে এখানে কাজ করছেন। তাই মূসক ফাঁকি দেওয়া বা দেরি করে দেওয়া বা মেরে দেওয়া গুরুতর অন্যায়।
হ্যাঁ, তবে আপনি অতীতে কখনো কোনো মূসক বা কোনো আয়কর ফাঁকি দেননি, অর্থাৎ আপনার কমপ্লায়েন্স রেকর্ড ভালো। তাহলে আপনার ফাইন মাপ হবে। বা প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগের শিকার হয়েছেন আপনি যেমন, বন্যা, খরা, আগুনে ব্যবসার ক্ষতি হওয়া, ভূমিকম্প, পরিবারের কারও মৃত্যুর কারণে আপনি সময় মতো জমা দিতে পারেননি সে ক্ষেত্রে জরিমানার ব্যাপারটিও বিবেচনার চোখে দেখা হতে পারে।
মূসকের ৯১তম পরিচ্ছেদের রেশ ধরে চেম্বারের সদস্যরা বলেছেন, করদাতাদের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করার ক্ষমতা রাজস্ব কর্মকর্তাদের দেওয়া হয়েছে যা নাকি ব্যবসায়ীদের হয়রানি বাড়াবে।
এ কথাও খুব একটা যুক্তিযুক্ত নয়। ব্যাংক হিসাব তো আর ঢালাও ভাবে ফ্রিজ করা হবে না। সেই সব করদাতার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হবে যারা ট্যাক্স ইভাসন করছেন বা মূসক ফাঁকি দিচ্ছেন।
মূসক হচ্ছে পরের টাকা। ভোক্তার কাছ হতে তা সংগ্রহ করেছেন আর তা আপনি সরকারের কোষাগারে জমা না দিয়ে নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে গচ্ছিত রাখছেন। তখন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজের কথা আসবে।
এ ছাড়াও যখন আপনার কাছে পাওনা বড় অঙ্কের অনাদায়ি মূসক ঝুঁকিতে পড়েছে বা আপনি রাজস্ব কর্মকর্তাকে অবজ্ঞা করছেন বা আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তার সরকারি কাজে আপনি কো-অপারেট করছেন না বা আপনার কাছে চাওয়া মূসক সংক্রান্ত সকল তথ্য-উপাত্ত, রেকর্ডস ও ডকুমেন্টস আপনি সরবরাহ করছেন না বা করলেও পরিপূর্ণ তথ্য না দিয়ে কিছু গোপন করছেন।
আপনার কর নিরীক্ষার কাজে এই সব পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেই আপনার ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের প্রশ্ন আসবে। অন্যথায় নয়।
যাই হোক, নতুন এই মূসক আইন নিয়ে অসন্তোষ কেবল ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের মধ্যেই সীমিত নেই এখন, দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরাও বলছেন বাংলাদেশের মতো দেশে ১৫ শতাংশ ভ্যাট অনাকাঙ্ক্ষিত। এ দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা এমনিতেই কম। তার ওপর ১৫ শতাংশ হারে মূসক দিতে হলে কেবল ভোক্তারাই চাপে পড়বে তা নয়। দেশের ব্যবসা বাণিজ্যে ও সামগ্রিক অর্থনীতিতেই একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ এই মূসক আইন নতুন এবং বাংলাদেশের ব্যবসাগুলি ঠিক অতটা আধুনিকভাবে হিসাব নির্ভর নয়। তাই কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব এই নতুন মূসককে সহনশীলতার মধ্যে রাখতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কর কাঠামো বা করের হার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে সার্কভুক্ত আমাদের পাশের দেশসমূহের কোথাও ১৫ শতাংশ হারে মূসক আরোপিত হয় না। এমনকি অনেক উন্নত আসিয়ানের দেশগুলোতেও এত উচ্চ হারে ভ্যাট নেই। আমাদের কানাডার এই অন্টারিও প্রদেশেও ফেডারেল গভর্নমেন্টের ৫ শতাংশ গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্স (জিএসটি) এবং প্রদেশের ৮ শতাংশ সেলস ট্যাক্স (পিএসটি) মিলিয়ে ১৩ শতাংশ হারে হারমোনাইজড সেলস ট্যাক্স (এইচএসটি) আরোপিত হয়।
তাহলে প্রশ্ন এসেই যায় যে, বাংলাদেশের ভোক্তারা কীভাবে ১৫ শতাংশ মূসক বহন করবেন। সেই বিবেচনায় আগামী ১ জুলাইয়ে নতুন মূসক আইনে আরোপিত মূসক হার একটি সহনীয় পর্যায়ে অর্থাৎ ১০ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে রাখার বিষয়টি সরকার, অর্থমন্ত্রী মহোদয় ও এনবিআরের কর্মকর্তাদের ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

*রানা টাইগেরিনা: ইমেইল <[email protected]>